নির্দিষ্ট কিছু এলাকা নয়। ওড়ার মুহূর্ত থেকে শুরু করে মাটি ছোঁয়া পর্যন্ত বিমানের গোটা যাত্রাপথই আসুক বাধ্যতামূলক নজরদারির আওতায়। এমএইচ ৩৭০ কাণ্ডের পর অন্তত এমনই দাবি করছেন ভারতীয় পাইলটদের একাংশ।
গত ৮ মার্চ গভীর রাতে মাঝ আকাশ থেকে স্রেফ হারিয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর। তার পর পেরিয়ে গিয়েছে এক মাস। কিন্তু ধ্বংসাবশেষ তো দূর অস্ত, বিমানটি অভিমুখ বদলে ঠিক কোন পথে গিয়েছিল সে ব্যাপারেও নিশ্চিত করে কিছু জানা নেই। ভরসা রাখতে হয়েছে উপগ্রহ থেকে পাওয়া কিছু তথ্য আর গাণিতিক বিশ্লেষণের উপর। আর ঠিক এখানেই আপত্তি তুলেছেন পাইলটরা। তাঁদের প্রশ্ন, উন্নত প্রযুক্তি আর উপগ্রহের নজরদারির মাঝেও কী ভাবে হারিয়ে গেল বিমানটি?
এ ব্যাপারে অনেকেই অবশ্য পাইলট জাহারি আহমেদ শাহের দিকে আঙুল তুলেছেন। অভিযোগ, তিনিই বিমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সে অভিযোগ মাথায় রেখে ভারতীয় পাইলটদের একাংশের বক্তব্য, বিমানচালক চাইলেও যাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ না করতে পারেন, এমন ব্যবস্থার প্রয়োজন অবিলম্বে।
কী রকম হতে পারে সেই ব্যবস্থা? পাইলট জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়ানে, “প্রথমেই দূরের উড়ানে স্যাটেলাইট ফোন-এর মাধ্যমে যোগাযোগ আবশ্যিক করা হোক। সে ক্ষেত্রে সেই ফোন-এর এলাকা বাড়ানো যেতে পারে।” তথ্য বলছে, নিখোঁজ এমএইচ ৩৭০-র ককপিটেও রাখা ছিল স্যাটেলাইট ফোন। তার ব্যবহার আবশ্যিক ছিল না। যার জেরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও জাহারি কেন সেই ফোন ব্যবহার করলেন না। জোরদার হতে থাকে নাশকতার সম্ভাবনাও।
কিন্তু সত্যি যদি নাশকতা বা বিমান ছিনতাই-ই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে পাইলট যে স্যাটেলাইট-ফোন ব্যবহারের নিয়ম মানবেন না সেটাই প্রত্যাশিত। তখন কী ভাবে বিমানের গতিবিধির উপর নজর রাখা সম্ভব হবে? এ ব্যাপারে পাইলটরা ভরসা রাখছেন উপগ্রহের উপর। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমানে গোটা বিশ্ব উপগ্রহের নজরদারির আওতায়। তাহলে সেই উপগ্রহ একটি বিমানের গতিবিধি কেন নজরে রাখতে পারবে না?
পাইলটদের এই ভাবনার সঙ্গে একমত নন এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বা এটিসি-র অফিসাররা। বিভিন্ন বিমানবন্দরে বসে এঁরাই বিমানের গতিবিধির উপর নজর রাখেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, এক এক জন কন্ট্রোলারকে দিনের ব্যস্ততম সময়ে একসঙ্গে ৪৫-৫০টি বিমানের উপরে নজর রাখতে হয়। প্রতিটি বিমানের পাইলট আকাশে নির্দিষ্ট ‘পয়েন্ট’-এ গিয়ে যোগাযোগ করেন কন্ট্রোলারের সঙ্গে। তার পরে সেই বিমান আবার পরবর্তী পয়েন্টের দিকে উড়ে যায়। এর মাঝে কন্ট্রোলার মনোনিবেশ করেন অন্য বিমানের উপরে। কিন্তু এক সঙ্গে ৪৫টি বিমানের প্রতি মূহূর্তের গতিবিধির উপর নজর রাখা কার্যত যে অসম্ভব, সে কথাও জানিয়ে দিলেন তাঁরা।
তবে উপায়? এক এটিসি অফিসারের কথায়, “এমন ব্যবস্থা চালু করতে হলে প্রথমেই যেটা দরকার তা হল কন্ট্রোলারের নজরদারি এলাকা কমিয়ে দেওয়া। ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে আকাশ।” অর্থাৎ বিমানগুলির যাত্রাপথের আরও কম অংশে নজরদারি চালাবেন এক এক জন কন্ট্রোলার। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আরও বেশি সংখ্যক ‘ফ্রিকোয়েন্সি’ (বিশেষ শব্দতরঙ্গ যার মাধ্যমে পাইলট এটিসির সঙ্গে যোগাযোগ করেন) ব্যবহার করতে হবে পাইলটকে। কারণ, দুই কন্ট্রোলারের ক্ষেত্রে একই ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা সম্ভব নয়। “তাতে আরও জটিল হয়ে যাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা’’ বললেন ওই অফিসার।
সমস্যা আরও রয়েছে। এটিসির এক অফিসার বললেন, “কলকাতার এটিসি-র আওতায় যে বিমানগুলি বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যায়, তাদের সঙ্গে আমরা অনেক সময়ে উপগ্রহ মারফত যোগাযোগ রাখি। তার জন্য আমাদের কাছে যেমন প্রযুক্তি থাকা দরকার, সংশ্লিষ্ট বিমানেরও সেই যন্ত্র থাকা দরকার। কিন্তু বেশিরভাগ বিমানেই সেই যন্ত্র নেই।”
অফিসারদের মতে, বিশ্বের সমস্ত বিমানে সেই যন্ত্র বসানোর খরচ যেমন রয়েছে, তেমনই প্রতিটি বিমানের প্রতি মূহূর্তের গতিবিধি নজর করার জন্য এটিসি-র পরিকাঠামোও বাড়ানো প্রয়োজন। প্রয়োজন লোকবলেরও। তার জন্য যে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ হবে তার যোগান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এটিসি-র অফিসারেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy