পাগলু নাচবেন না। বসন্তী টাঙ্গা চালাবেন না। ‘কুহেলী’র নায়ক-নায়িকা পিয়ানো বাজিয়ে গাইবেন না ‘তুমি রবে নীরবে’। ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চ্যানেল দূরদর্শনের পর্দায় থাকবেন না দেব, হেমা মালিনী, বিশ্বজিৎ-সন্ধ্যা রায়ের মতো তারকা প্রার্থীরা। দেখা যাবে না তাঁদের করা সরকারি বিজ্ঞাপনও।
ভোটে নিরপেক্ষতার স্বার্থে প্রসার ভারতীর জন্য আপাতত এই নির্দেশ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। বেসরকারি চ্যানেল অবশ্য তাদের এক্তিয়ারের বাইরে। তাই দেব-সঞ্চালিত জনপ্রিয় নাচের রিয়্যালিটি শো বন্ধ হচ্ছে না। বেসরকারি চ্যানেলে ‘শোলে’ দেখানোতেও কোনও বাধা নেই। তবে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে ভোট সংক্রান্ত যে বিতর্কগুলি হচ্ছে, তাতে রাজনৈতিক নেতাদের পরিবর্তে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের উপস্থিতির উপর জোর দিতে চাইছে কমিশন। প্রাথমিক ভাবে এই নিয়ম চালু করার কথা ভাবা হয়েছে দূরদর্শনেই।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ জারি করেছে কমিশন। লোকসভা ভোটের ন’টি দফা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে যে কোনও ধরনের জনমত সমীক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশে একাধিক পর্বে ভোট গ্রহণের রেওয়াজ চালু হওয়ার পর থেকেই ভোট চলাকালীন বুথ-ফেরত সমীক্ষা নিষিদ্ধ করেছিল কমিশন। কারণ, এই ধরনের সমীক্ষার ফল পরবর্তী পর্বের ভোটে প্রভাব ফেলে। জনমত সমীক্ষায় ছাড় ছিল ঠিকই, কিন্তু অলিখিত নির্দেশও ছিল যে, ভোট শুরু হওয়ার পরে আর তা করা যাবে না। কমিশনের বক্তব্য, স্পষ্ট কোনও নির্দেশ না থাকার এই সুযোগ নিয়েই চার দফা ভোটের পর গত ১২ এপ্রিল নির্বাচনী বিশ্লেষণের নামে একটি অনুষ্ঠান করেছিল বেসরকারি একটি সংবাদমাধ্যম। তাতে গোটা দেশে কী ফলাফল হতে পারে, সেই সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়। যা পরের দিন বেশ কিছু সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। তার পরেই নড়ে বসে কমিশন। তাদের মতে, ভোট শুরুর পরে এই ধরনের সমীক্ষা নির্বাচনী বিধিভঙ্গের সামিল।
কমিশনের বক্তব্য, নিরপেক্ষ নির্বাচন করানোর লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ। লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার ঠিক আগে নিরপেক্ষতা প্রশ্নেই এক প্রস্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মণীশ তিওয়ারি এবং প্রসার ভারতীর সিইও জহর সরকার। অভিযোগ ওঠে, নির্বাচনী প্রচারে দূরদর্শনকে শাসক দলের পক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন মণীশ। বিষয়টি গড়ায় নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত। বৈঠকে বসেন কমিশন ও প্রসার ভারতীর কর্তারা। কমিশন স্পষ্ট বলে, নিরপেক্ষতার প্রশ্নে কোনও সমঝোতা যাতে করা না হয়।
বস্তুত, সেই অবস্থান থেকেই সরকারি গণমাধ্যমে তারকা প্রার্থীদের অনুষ্ঠানে লাগাম পরানোর সিদ্ধান্ত।
একটি সূত্রের বক্তব্য, কোনও তারকা মনোনয়ন পেশ করা মাত্রই সরকারি চ্যানেলে তাঁর অনুষ্ঠানের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার নিয়ম এত দিন ধরে ছিলই। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কমিশন গত কাল এ ব্যাপারে আলাদা নির্দেশ জারি করেছে, যাতে ভোটারদের প্রভাবিত করতে সরকারি চ্যানেলকে ব্যবহারের অভিযোগও না ওঠে।
প্রসার ভারতীর সমস্যাটা অবশ্য এখন অন্য জায়গায়। বর্তমানে জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলিয়ে দূরদর্শনের চ্যানেলের (যেমন ডিডি নিউজ, ডিডি ন্যাশনাল, ডিডি বাংলা ইত্যাদি) সংখ্যা একশোর কাছাকাছি। এতগুলি চ্যানেলে নিরপেক্ষতা বজায় রইল কি না, সে দিকে বিশেষ নজর রাখা কঠিন। সমীক্ষা বলছে, এ বারের নির্বাচনে ফিল্মি তারকা প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখজনক ভাবে বেড়েছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল বা বিজেপির নতুন প্রার্থীদের একটা বড় অংশই টলিউড ও বলিউডের প্রতিনিধি। দক্ষিণেও চিত্রতারকা প্রার্থী কম নেই। ফলে আঞ্চলিক চ্যানেলেগুলিও যাতে নিরপেক্ষতা না হারায়, সে দিকে বিশেষ ভাবে নজর রাখতে হবে প্রসার ভারতীকে। কমিশনের এক কর্তার কথায়, “গোটা দেশেই চিত্রতারকারা ভোট টানতে নিজেদের জনপ্রিয় ছবির সংলাপ বা গানের সাহায্য নিয়ে থাকেন। তা বন্ধ করা সম্ভব নয়। বেসরকারি চ্যানেলগুলিকে আটকানো সম্ভব নয়। কিন্তু অন্তত দূরদর্শনে যাতে চিত্রতারকা প্রার্থীদের সিনেমা দেখানো বন্ধ থাকে, তার জন্য প্রসার ভারতীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এর পাশাপাশি, বিভিন্ন চ্যানেলে ভোট সংক্রান্ত বিতর্কগুলিতে কারা যোগ দেবেন, সে বিষয়েও কড়া নিয়ম আনার কথা ভাবছে কমিশন। তাদের মতে, টিভিতে এ ধরনের বিতর্কের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও ভোটারদের প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই নিরপেক্ষ ব্যক্তিরাই যাতে রাজনৈতিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন, সে বিষয়েও নিয়ম আনার কথা ভাবছে কমিশন। তবে দূরদর্শনের বাইরে কোথাও এই লাগাম পরানো যাবে কি না, রয়ে যাচ্ছে সেই প্রশ্নও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy