ছোট একটি রাজ্য থেকে এসে কেন্দ্রে গুরুভার মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েছেন ক’জন? চটজলদি কোনও নাম মনে পড়বে না! মনোহর পারিক্কর হয়তো সেই বিরল নজির গড়তে চলেছেন। গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে আজ ইস্তফা দিলেন তিনি। কাল মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে রাইসিনা পাহাড়ে শপথ নেবেন। আগাম জল্পনা, মন্ত্রিসভার ‘বিগ ফোর’ তথা শীর্ষ চারের একজন হয়ে উঠতে পারেন পারিক্কর। প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা হতে পারে তাঁকে। চলতি মাসে উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভায় জিতিয়ে আনার পরিকল্পনাও প্রায় চূড়ান্ত।
মোদী মন্ত্রিসভার প্রথম সম্প্রসারণে কেন্দ্রীয় চরিত্র এখন মনোহরই। জাতীয় রাজনীতিতে কার্যত প্রাসঙ্গিকতাহীন একটি রাজ্য গোয়া। পর্যটন ও খনির জন্যই যার পরিচিতি। বিজেপি বলছে, সেখান থেকে ‘মণি’ তুলে আনলেন মোদী। কারণ, দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ-দীর্ণ গোয়া রাজনীতিতে সত্, সাধাসিধে, সপ্রতিভ অথচ নম্র, পোশাক-ব্যবহারে ‘ভেক বর্জিত’ এমন রাজনীতিক যেমন বিরল, তেমন জাতীয় স্তরেও অমিল।
গোয়া আজও বাঙালির পছন্দের জায়গা। তবু রাজনীতি সচেতন বাঙালির কাছেও মনোহরের পরিচিতি রয়েছে কিনা সন্দেহ! তাই জানিয়ে রাখা ভাল, গোয়ার মাপুসার এই ব্রাহ্মণ সন্তান ছোটবেলা থেকেই শান্ত, কৃতী ছাত্র। লয়োলা স্কুলে পড়ার সময় চুটিয়ে ফুটবল খেলতেন। পরে মুম্বই আইআইটি-তে মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছেন। ‘আধার’ কর্তৃপক্ষের প্রধান নন্দন নিলেকানি তাঁর ব্যাচ মেট। এবং তিনিই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যিনি আইআইটি-র প্রাক্তনী। ’৯৪ সালের প্রথম বার পানজিম থেকে বিধানসভায় নির্বাচিত হন। তার পর সেখান থেকেই টানা পাঁচ বার জিতে গোয়ায় রেকর্ড করেছেন। সর্বদা বুশ শার্ট আর ট্রাউজার্স পরেন, পায়ে কাবলি জুতো। গোয়ায় মুখ্যমন্ত্রী নিবাসে আমজনতার প্রবেশ অবাধ।
সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এ হেন মনোহরের উত্থানের কাহিনীটাই এখানে প্রাসঙ্গিক। এক বিজেপি নেতার মতে, সেই বীজ সম্ভবত পোঁতা হয়েছিল ২০০২ সালে। সে বার জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক ছিল গোয়ায়। গুজরাত দাঙ্গার পর তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ঝড় বইছে। বিরোধীরা ইস্তফা চাইছেন, আর অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে রাজধর্মের পাঠ দিচ্ছেন। কিন্তু আডবাণীর মতোই মনোহর দাঁড়ান মোদীর পাশে। তখনই তিনি মুখ্যমন্ত্রী। ১১ বছর পর ২০১৩ সালে ফের বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক হয় গোয়ায়। সে-ও এক মাইলফলক। মনোহরই প্রস্তাব দেন, মোদীকেই লোকসভা ভোটে দলের প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান করা হোক।
ছাত্রাবস্থা থেকেই আরএসএসের একনিষ্ঠ স্বয়ংসেবক মনোহর। সঙ্ঘ নেতাদের বরাবরের নেক নজরে ছিলেন তিনি। তাই ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের পর মনোহরকে বিজেপি সভাপতি করতে চেয়েছিলেন মোহন ভাগবতরা। তাতে বাধা দেন আডবাণী। কারণ, আডবাণীকে ‘পুরনো আচার’ বলে এক বার বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছিলেন পারিক্কর। আডবাণী যুগ এখন অস্তাচলে। এই অবস্থায় মনোহরের উত্থানের কারিগর হিসেবে প্রকাশ্যে মোদীকে দেখা গেলেও পর্দার আড়ালে সঙ্ঘের সংকেতও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে সঙ্ঘ অনুগামী কাউকে বসানোটা তাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তার সঙ্গে খাপ খায়।
যদিও বিজেপির এক নেতার কথায়, মনোহর সঙ্ঘের অনুগত সৈনিক হলেও ‘ছাঁচে ঢালা’ কট্টরপন্থী নন। তিনি আধুনিকমনস্ক। এতটাই যে, সঙ্ঘের কিছু কট্টর সমর্থক গোয়ায় মদ ও নিশিনিলয় নিষিদ্ধ করতে চাইলেও, পর্যটনের স্বার্থে পারিক্কর তাতে সায় দেননি। মোদীও মন্ত্রিসভায় আধুনিকমনস্ক মুখ চান। মন্ত্রিসভার শীর্ষ চারের মধ্যে দু’জন সুষমা স্বরাজ ও রাজনাথ সিংহের সঙ্গে তাঁর মানসিক সখ্য নেই। রয়েছেন শুধু অরুণ জেটলি। এই অবস্থায় নিজের ও সঙ্ঘের অনুগামী মনোহরকে শীর্ষ চারে এনে কিছুটা ভারসাম্য রাখতে চাইছেন তিনি।
পর্তুগিজরা গোয়া ছাড়ার পর সেখানে দুর্জয় ঘাঁটি ছিল কংগ্রেসের। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের আস্থা ধরে রেখেও সেখানে হিন্দুত্বের মতাদর্শে চলা একটি দলের ভিত মজবুত করার কৃতিত্ব মনোহরের ঝুলিতেই যায়। ২০০২ সালে সরকার ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র টের পেয়ে নিজেই ভোটে চলে গিয়েছিলেন। জোট সরকার গড়ে তিনিই ফের ক্ষমতায় আসেন। ২০১২ সালে পারিক্করের নেতৃত্বে গোয়ায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজেপি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মতো পেট্রোলের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেন মনোহর। যদিও কর্পোরেট জগতের খেদ হল, মনোহরের ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কম।
তবে দলের নেতারা বলছেন, কেন্দ্রে সরকার চলছে মোদীর সামগ্রিক নীতির ভিত্তিতে। মনোহরও সেই নীতিতেই কাজ করবেন। কেন্দ্রে সফল হতে পারলে তাঁর জাতীয় রাজনীতিতে লম্বা ইনিংস নিশ্চিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy