লোকসভা ভোটের আগে ইস্তাহার প্রকাশ বলে কথা! ভোটের ময়দানে পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন, ২৪ আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরে আজ সকাল থেকেই উৎসবের পরিবেশ। সুসজ্জিত মঞ্চে সনিয়া গাঁধী থেকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। নেতা-সমর্থকদের ভিড়ে মধ্যমণি রাহুল। অথচ এমন দিনে গত চার দশক ধরে কংগ্রেসের মঞ্চে কার্যত প্রধান ভূমিকা নিতেন যিনি, দেখা মিলল না তাঁর।
প্রণব মুখোপাধ্যায়। কে জানে! রাইসিনা হিলসে বসে হয়তো টেলিভিশনেই দেখলেন কংগ্রেসের ইস্তাহার প্রকাশ!
‘মিস’ করছেন না?
গত শনিবারই রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে এক অনুষ্ঠানে সনিয়ার সঙ্গে দেখা প্রণবের। ১০ জনপথ ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানাচ্ছেন, অনুষ্ঠানের পর চা-চক্রে ঘরোয়া মেজাজে সনিয়াই প্রশ্নটা ছুড়েছিলেন প্রণববাবুর দিকে। পরে কংগ্রেস সভানেত্রী দলের কিছু নেতাকে সে কথা জানান। একই সঙ্গে বলেন, তিনি কিন্তু প্রণববাবুকে জানিয়েছেন, তাঁকে ‘মিস’ করছে দল। কংগ্রেসের ইস্তাহার রচনা হচ্ছে, অথচ প্রণববাবু নেই গাঁধী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়া ইস্তক এমনটা তিনি অন্তত দেখেননি!
শুধু ইস্তাহার রচনা নয়, সনিয়া জমানায় দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন প্রণববাবু। বস্তুত, চার দশকের ভোট পর্বে কংগ্রেস শিবিরের রণনীতির মূল কারিগরই প্রণববাবু। তাই আজ কংগ্রেসের বর্ষীয়ানদের আলোচনায় বারবার উঠেছে তাঁরই কথা। ইস্তাহার লিখতে কখনও আকবর রোডের কংগ্রেস দফতরে, কখনও বা তালকাটোরা রোডে তাঁর তৎকালীন বাসভবনে বৈঠক, যুক্তি-তর্ক, শব্দের চয়ন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, আবার কোনও মতান্তর হলেই দুম করে রেগে যাওয়া এ সবই আজ বারবার ঘুরে ফিরে উঠে এসেছে ওই প্রবীণ নেতাদের স্মৃতিচারণে।
দলের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির বৈঠকে নিদেনপক্ষে দু’-তিন দিন এমন হতো যে রেগে বৈঠক ছেড়েই বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেন প্রণববাবু। দুয়েক বার তো রেগে বাড়ি চলেও গিয়েছিলেন তিনি। রাগ পড়লে সনিয়াকে ফোন করতেন। বা তাঁকে ফোন করে শান্ত হতে বলতেন সনিয়া। নির্বাচন কমিটির বৈঠকে প্রণববাবুর পাশেই বসতেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। রাগ করে উঠতে গেলে অনেক বার মনমোহনও তাঁকে হাত ধরে টেনে বসিয়েছেন।
ষাটের দশক থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে কৌশল রচনায় সক্রিয় ছিলেন প্রণববাবু। বাংলা কংগ্রেসের ইস্তাহার রচনা দিয়ে হাতেখড়ি। পরে ইন্দিরা জমানা থেকেই কংগ্রেসের ইস্তাহার প্রস্তুতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেন তিনি। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্যের কথায়, “আসলে ইন্দিরাজি জানতেন, কাকে দিয়ে কী হবে! সে জন্য প্রণববাবুকে নীতি নির্ধারণ ও ইস্তাহার রচনায় সামিল করেছিলেন।”
প্রণববাবুর উপযোগিতা রাজীব গাঁধীও জানতেন। তাই কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারের পর রাজীব যখন তাঁকে ফের দলে আনেন, তখন প্রণববাবুকে ইস্তাহার রচনা ও ভোট কৌশল নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সামিল করেন। নরসিংহ রাও জমানা এবং গত দুই লোকসভা ভোটেও কংগ্রেসের ইস্তাহার কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রণববাবুই।
ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য দিগ্বিজয় সিংহের মতে, এটা একটা যুগ-শেষের বার্তা দিচ্ছে। দলের অনেক বর্ষীয়ান নেতাই এখন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যে ভাবে ইস্তাহার রচনা করেছেন রাহুল গাঁধী, তার সঙ্গে হয়তো খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন না প্রণববাবু। ইস্তাহার রচনার জন্য রাহুল সরাসরি কথা বলেছেন সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বর্ষীয়ানদের পরিবর্তে ইস্তাহার প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নবীনদের ভূমিকা। ইস্তাহারের খসড়া চূড়ান্ত করতে নিয়োগ করা হয়েছে পেশাদার সংস্থা এবং বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের।
রাষ্ট্রপতির ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, এই পরিবর্তন অবশ্য প্রণববাবুকে আর স্পর্শ করছে না। তাঁর কাছে এখন সবটাই নস্টালজিয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy