এক জনের জন্য পাণিপ্রার্থীদের লাইন পড়ে যাচ্ছে, তো অন্য জনের জন্য সম্বন্ধ জোটানোই ভার!
ভাইব্র্যান্ট গুজরাত-এর সঙ্গে বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের তফাতটা বোধহয় এমনই।
সদিচ্ছা থেকে আয়োজন পার্থক্য এতটাই যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও বলতে হয়, নিজের খেয়ালে রাজ্য চালালে উন্নয়ন অসম্ভব। ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের আসরেই এ দিন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে কোনও রাজ্যেই তার প্রশাসনকে এগোতে হবে নীতিনিষ্ঠ হয়ে। খেয়ালের বশে রাজ্যপাট চালালে তাতে আর যা-ই হোক পুঁজি আসে না। রাজ্যে রাজ্যে শিল্প-বাণিজ্য সম্মেলন প্রসঙ্গ তুলে তিনি বললেন, “এখন তো অনেক রাজ্য একই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। এই তো কিছু দিন আগে মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যও শিল্প সম্মেলন করল। এমন যে কোনও উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত রকম সহযোগিতা করবে।”
প্রধানমন্ত্রী কারও নাম করেননি, কারও দিকে ইঙ্গিত করেননি। তবু সদ্য শেষ হওয়া ‘ফাটাফাটি, ফ্যাবুলাস’ বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের প্রসঙ্গ আলোচনায় এসে পড়ল এই কথার পরেই। মহাত্মা মন্দিরে শিল্পপতিদের গোলটেবিলে উঠল একটি নামও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন উঠল, খোঁচাটা কি তা হলে মমতাকেই দিলেন মোদী? কারণ খেয়ালখুশিকে প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে শিল্প মহলের কাছে মমতার নামই আগে আসে। মমতাই সেই মুখ্যমন্ত্রী যিনি শিল্পকলা এবং শিল্পবাণিজ্যের মধ্যে বিশেষ ফারাক করেন না!
ভাইব্র্যান্ট গুজরাত আর বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্বের নেপথ্যেও, শিল্পপতিরা মনে করেন, মমতার খেয়ালি নীতিই অনেকটা দায়ী। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে এখন শিল্পের প্রধান বাধা জমি। যে-হেতু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনে ভর করে ক্ষমতায় এসেছেন, তাই শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবেন না, এখনও ধনুকভাঙা পণ মমতার। এ বারের সম্মেলনেও সে নিয়ে শিল্পমহলের প্রশ্নের কোনও জুৎসই জবাব দিতে পারেননি তিনি। আর মোদী সরকার অর্ডিন্যান্স করে কেন্দ্রের আইনে বদল এনে অধিগ্রহণ সহজতর করছে। উল্টো দিকে, সারা দেশে অচল হয়ে যাওয়া ল্যান্ড সিলিং আইন আজও বহাল পশ্চিমবঙ্গে। সারা দেশে জলকর চালু হলেও কলকাতার বিনা পয়সায় জল খাওয়ানো আজও চলছে। এমনকী, সিঙ্গুর থেকে টাটাদের বিতাড়নের জন্য ভুল স্বীকারেও নারাজ মুখ্যমন্ত্রী। বিমা বিল, কয়লা বিল, জিএসটি কিংবা প্রতিরক্ষায় বেসরকারিকরণেও আপত্তি আছে তাঁর।
পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি আছে মুম্বইবাসী এমন এক শিল্পপতির কথায়, “নীতি আর মমতা তো একে অপরের বিপরীত শব্দ। জমি বিল থেকে সিঙ্গুর, হয় নীতিহীনতা নয়তো ভ্রান্ত নীতি আঁকড়ে রয়েছেন তিনি। তাই কেউই আজকাল পশ্চিমবঙ্গে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।” শিল্পমহলের মতে, যেখানেই নীতির প্রশ্ন, সেখানেই খেয়ালকে আগে রাখেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাই কলকাতায় এসে কেন্দ্রীয় অথর্মন্ত্রী অরুণ জেটলিকে বলতে হয়, কারও খামখেয়ালিপনায় রাজ্যসভা অচল হতে পারে, কিন্তু তা বলে দেশ অচল হবে না।
এই খামখেয়ালে চলে বলেই সল্টলেকের মাঠে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে দু’দিন ধরে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে শিল্প আহ্বান করতে হয়। সম্মেলন শেষে যে বিপুল অঙ্কের সম্ভাব্য বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করা হয়, তার কোনও প্রামাণ্য বা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও থাকে না প্রশাসনিক কর্তাদের হাতে। আর আমদাবাদের মহাত্মা মন্দিরে জানাই যায় না, কে গুজরাত সরকারের অর্থমন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী সৌরভ পটেল পিছনের সারিতে চুপ করে বসে থাকেন। আর মুকেশ অম্বানী মাইক ধরে বলেন, “আমার গুজরাতি কোম্পানির জন্য আমি গর্বিত। ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের সাতটি সম্মেলনেই আমি উপস্থিত থেকেছি। আসুন, এই রাজ্যে বিনিয়োগ করুন।” সানন্দে নতুন কারখানা খুলে সুজুকি মোটর্সের সিইও ওসামা সুজুকি বলেন, “ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির ইঞ্জিন হল গুজরাত।” দিনের শেষে জানানো হয়, ৩১টি মউ সই হয়েছে।
এই খামখেয়াল চলে বলেই মহাত্মা মন্দিরে চাঁদের হাট, আর বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন ফাঁকা। কলকাতার শিল্প সম্মেলনে ডাক পেয়েও হাজির হন না দেশের নামজাদা শিল্পপতিরা। আর আমদাবাদে ডাকই পান না কলকাতার শিল্পপতিরা। কলকাতায় যাঁদের সচরাচর দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে যোগী দেবেশ্বর ও প্রসূন মুখোপাধ্যায় (তা-ও এ বার বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে প্রসূনবাবুকে দেখা যায়নি) ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়ে না মহাত্মা মন্দিরে। গ্লোবাল সামিটে একটি দেশকেও পার্টনার হিসেবে পায়নি পশ্চিমবঙ্গ। আর গুজরাতের পার্টনার হওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে পশ্চিমী দেশগুলি। ১৩১ জন প্রতিনিধি নিয়ে এসেছেন মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি। তাঁর নিজেরই ঘোষণা, এর আগে এত বড় বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ভারতে আসেনি। শুনে ব্রিটেনের মন্ত্রী লর্ড লিভিংস্টোনের পাল্টা দাবি, “আমাদেরও ১০০ জনের বেশি প্রতিনিধি এসেছেন।” কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী আবার শুনিয়ে দিলেন, “ভুলে গেলে চলবে না, ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের প্রথম দিন থেকে স্থায়ী পার্টনার আমরাই।”
আর তৃপ্ত মুখ্যমন্ত্রী আনন্দী বেন পটেল বলছেন, গুজরাতের প্রথম দফার উন্নয়নের কাজ শেষ। এ বার দ্বিতীয় দফা। জোরদার উন্নয়নে ঝাঁপ দিতে হবে। তার মূল মন্ত্র হল, গতিশীল গুজরাত। যদিও তৃণমূলের দাবি, এ সবই ‘সাজানো অনুষ্ঠান’। সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায়, ‘‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের নামে যা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে মরীচিকা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রযোজনায় সাজানো অনুষ্ঠানের একটা অংশ মঞ্চস্থ হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy