লৌহপুরুষেরও চোখে জল। সেন্ট্রাল হলের বৈঠকে। ছবি: পিটিআই।
ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতির হুঙ্কার শুনেছে মানুষ। কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখল আজ।
সদ্য সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর তারিফ করতে গিয়ে প্রথমে চোখে জল এসে গিয়েছিল লালকৃষ্ণ আডবাণীর। দলের উপর ‘কৃপা’ করার জন্য মোদীকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি।
গুরুর পর এ বার শিষ্যের পালা। বক্তৃতার মাঝে পোডিয়ামে মাথা ঝুঁকে পড়ল মোদীর। কী হল? কী হল? উসখুস সাংসদরা। ব্যতিব্যস্ত সংবাদমাধ্যমও। ঝুঁকে যাওয়া মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাইকে ভেসে আসছে শুধু কান্নার শব্দ। মুখ তুলে একটু জল খেলেন। ধরা গলায় একটু সামলে নিয়ে বললেন, “আডবাণীজিকে অনুরোধ, অনুগ্রহ করে কৃপা শব্দটা ব্যবহার করবেন না। মায়ের সেবা কখনও কৃপা হয়? ভারত যেমন আমার মা, বিজেপিও তো মা!”
নিমেষে আডবাণীর চোখে ফের জল। ছলছল মুরলী মনোহর জোশীর চোখও। মোদীর কথা শুনে চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছে রবিশঙ্কর প্রসাদ, মুখতার আব্বাস নকভি, গোপীনাথ মুন্ডের। আশপাশে তাকিয়ে এক আঙুলে চোখের জল মুছলেন স্মৃতি ইরানি। লাল রুমাল বের করলেন সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়াও। নির্বাচনে কঠিন লড়াই করেছেন সকলেই। সেই লড়াইয়ের কান্ডারি যখন বিজেপিকে ‘মা’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন, সেই শব্দ ছুঁয়ে গেল সকলের মন।
মোদী যখন অটলবিহারী বাজপেয়ীর কথা বললেন, তখনও আরও এক বার। যদি সংসদে এই মুহূর্তটার সাক্ষী থাকতে পারতেন বাজপেয়ীজি!
বিজেপির সব নেতাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, এ দিনের এই কান্না আগাম ছকে রাখা কোনও চিত্রনাট্যের অঙ্গ নয়। কিন্তু ঘটনা হল, ভোটের ফল প্রকাশের পরেও লালকৃষ্ণ আডবাণী-সুষমা স্বরাজের মতো নেতারা জয়ের পূর্ণ কৃতিত্ব দেননি মোদীকে। আজ মোদীর নাম সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে প্রস্তাব করার সময় আডবাণী বলেন, “আমার একটা দুর্বলতা আছে। চোখে জল এসে যায়।” দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়, জরুরি অবস্থা বিলোপের সময় কেঁদে ফেলেছিলেন। আর আজ নরেন্দ্র মোদীর নাম প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য ঘোষণা করতে গিয়েও কেঁদে ফেললেন। প্রকাশ্যে বললেনও সে কথা। কিন্তু চোখের জলে ভেসে মোদীর তারিফ করার মধ্যেও একটা সূক্ষ খোঁচা ছিল আডবাণীর সুরে। দলকে ‘কৃপা’ করার কথা বলে মোদীকে পাল্টা জবাব দেওয়ার সুযোগ করে দেন তিনি।
মোদী সেই সুযোগটা ছাড়েননি। বিপুল জনমত পেয়ে আজ তিনি বিজেপির সর্বেসর্বা। নতুন সরকারে আডবাণীর ভূমিকাও এখন তাঁর হাতে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাই জবাব দিলেন মোদী। শ্রদ্ধার মোড়কেই। আডবাণীর চোখে জল এসেছিল, আর ভরা সভায় কান্না এল মোদীর চোখে, গলাতেও।
তবে মোদী-ঘনিষ্ঠ নেতারা বলছেন, “এর পিছনে কোনও রাজনীতি নেই।” তাঁদের দাবি, অটল-আডবাণীর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার কথা বারবারই বলে এসেছেন মোদী। আজও আডবাণী ফুলের তোড়া নিয়ে একটু এগিয়ে আসতেই মোদী তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন। আডবাণীর চোখে তখনও জল ছিল।
কিন্তু আডবাণীর পাশাপাশি আজ যে ভাবে বাজপেয়ীর কথাও সুকৌশলে টেনে এনেছেন মোদী, সেটা অনেকে মনে করছেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর অতীত মন্তব্যের সূক্ষ্ম জবাব। ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার পর মোদীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আডবাণী। কিন্তু বাজপেয়ী তাঁর অপসারণ চেয়েছিলেন। সম্ভব হয়নি আডবাণীর জন্যই। সেই সময় মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালন করতে বলেছিলেন বাজপেয়ী। আজ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেই রাজধর্ম পালন করতে চলেছেন মোদী। সেই মুহূর্তে বাজপেয়ীকে স্মরণ করে তিনি সেই পুরনো কথাটাই ফিরিয়ে দিতে চাইলেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা থাকছেই।
তবে দলের মধ্যে বেসুরোদের আর যে কোনও ঠাঁই নেই, প্রথম দিন থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে গেল। যে সুষমা স্বরাজ মোদীকে প্রধানমন্ত্রী-প্রার্থী করার বিরোধিতা করে এসেছেন, আজ তাঁকেই মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে হল। নির্বিরোধ সমর্থন নিয়েই নেতা হলেন মোদী। তার পর গেলেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। সেখানে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে নিয়োগ করলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। শপথগ্রহণ সোমবার, সন্ধ্যা ছ’টা। মোদী রাষ্ট্রপতিকে বললেন, “প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে আপনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটি শুনেছি। জয়ের পর আপনার সেই কথাটিই আমি দু’বার ব্যবহার করেছি।” প্রণববাবুও হেসে বললেন, “হ্যাঁ, আমি শুনেছি।”
কী কথা? রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তৃতায় দেশের জনগণকে একটি স্থায়ী সরকার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। জনগণ সেই অনুরোধ রেখেছে। আজ স্থায়ী সরকার নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসছেন নরেন্দ্র মোদী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy