মনিকা খানগেমবাম। সৌজন্যে ফেসবুক।
আপনাকে ঠিক আমার মতো দেখতে নয়। মুখের ছাঁচটা আলাদা মনে হচ্ছে। রংটাও তো মেলে না দেখছি। আর ভাষাটা তো একেবারেই আলাদা।
অতএব আপনি ভারতীয় নন। কারণ আমি ভারতীয়। আর আপনি যখন আমার মতোন নন, তখন আপনার ভারতীয়ত্ব নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
দিল্লির বিমানবন্দরে কর্তব্যরত এক সরকারি অফিসার মণিপুরে মনিকা খানগেমবামকে অনেকটা এই রকমই বলেছেন। সরাসরি না বললেও, আচারে-আচরণে বেশ স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়া যাবেন বলে দিল্লির বিমান বন্দরে পৌঁছেছিলেন মনিকা। বৈধ পাসপোর্টই দেখিয়েছিলেন। কিন্তু মনিকার মুখ দেখে কর্তব্যরত সরকারি কর্তার মনে হল, এই মানুষটা ভারতীয় হতে পারেন না। তাই জেরায় জেরায় জেরবার করা শুরু। কোনও প্রশ্নেই ঘায়েল করা যায়নি মনিকাকে। তা সত্ত্বেও সব শেষে কর্তব্যরত আধিকারিকের আবার প্রশ্ন, ‘সত্যিই ভারতীয় তো?’
কী অর্থ এর? কোনও এক ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চেনা যায় কীসের ভিত্তিতে? মুখমণ্ডলের গঠন দেখে? গাত্রচর্মের বর্ণ দেখে? কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে? ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞাটা ওই আধিকারিকের কাছে ঠিক কী? ভারতীয়ত্বের ধারণায় ঠিক কতগুলি জাতিসত্ত্বা নিহিত রয়েছে, সে প্রশ্ন ওই আধিকারিককে না-ই বা করলাম। শুধু জানতে চাইছি, এক ঝলক দেখেই কাউকে ভারতীয় হিসেবে চিনে নেওয়ার মাপকাঠিটা ঠিক কী? কোনও নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলা জরুরি? দেশের নির্দিষ্ট কোনও এক অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়া জরুরি? নাকি ভারতীয়ত্ব নির্ধারণের ভার যখন যে সরকারি কর্তার উপর থাকবে, তাঁর মতো হওয়া জরুরি?
সে ক্ষেত্রে কর্তা যদি বাঙালি হন, তা হলে রাজপুত বা জাঠকে দেখে তিনি ভারতীয়ত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করবেন। কর্তা যদি পঞ্জাবি হন, তিনি মরাঠিকে দেখে ধন্দে পড়ে যাবেন। কর্তা যদি হন কাশ্মীরি, তিনি তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালিকে কিছুতেই ভারতীয় ভাবতে চাইবেন না। আর কর্তা যদি হন অসমিয়া বা মণিপুরি বা বড়ো বা নাগা বা মিজো, তিনি মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশের লোকজনকে ভারতের নাগরিক হিসেবে মানতে অস্বীকার করবেন।
বহুত্বের কথা বার বার বলি বটে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বুলি আউড়ে ভারতীয়ত্বের মহানতাও প্রমাণ করতে চাই। কিন্তু বহুত্ব আসলে কী, তা আমাদের অনেকেরই ভাল করে জানা নেই। কী কী বিচিত্র বিষয় একীভূত হয়েছে ভারতীয় জাতীয়তার ধারণায়, সে সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশেরই কোনও ধারণা নেই। আগ্রহও বোধ হয় তেমন নেই।
সংখ্যায় যাঁরা কম, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠকে সব সময় সমীহের সঙ্গে চিনে রাখবেন। কিন্তু সংখ্যালঘুকে ভারতীয় জনসংখ্যার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিনে রাখার কোনও দায় সংখ্যাগরিষ্ঠের থাকবে না। চেতনে হোক বা অবচেতনে, চিন্তা-ভাবনার প্রবাহটা আমাদের অনেকটা এই রকমই। তাই মনিকা খানগেমবামকে কিছুতেই ভারতীয় হিসেবে মেনে নিতে ইচ্ছা করে না।
এই কারণেই দিল্লিতে বার বার আক্রান্ত হতে হয় উত্তর-পূর্ব ভারতের পড়ুয়াকে। এই জন্যই অসমে কখনও ‘বাঙাল খেদা’ হয়, কখনও বিহারি বিতাড়ন হয়। আর চিন্তা-ভাবনার এই একবগ্গা, ঠুলি পরা প্রবাহই ‘আমচি মুম্বই’ রব তুলে দেয়।
ভারতীয়ত্বে মিশে থাকা বহুত্ব নিয়ে শুধু গর্ব করলেই দায় শেষ নয়। সেই বহুত্বকে জানতে হবে। আত্মস্থও করতে হবে। না হলে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক হয়ে ওঠা যাবে না।
মনিকা খানগেমবাম অনেক বেশি ভারতীয়। কারণ বিমান বন্দরে কর্তব্যরত সরকারি কর্তা ঠিক তাঁর মতো নন দেখেও, ওই সরকারি কর্তাকে ভারতীয় হিসেবে চিনে নিতে মনিকার ভুল হয়নি। আধিকারিকের কিন্তু ভুলটা হয়েছে। অতএব, ওই আধিকারিক প্রকৃত অর্থে ভারতীয় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থেকে যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy