মহাবলীপুরমের রিসর্ট থেকে চেন্নাইয়ের পথে শশিকলা। ছবি: পিটিআই।
দুই বাঙালির কলমেই আপাতত শেষ শশিকলার ৪৫ দিনের রাজনৈতিক জীবন।
বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ এবং বিচারপতি অমিতাভ রায়। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় দুই বিচারপতি যখন সুপ্রিম কোর্টের ভিড়ে ঠাসা ছয় নম্বর এজলাসে ঢুকলেন, তখন ঘরে পিন পতনের নীরবতা। ৫৭০ পৃষ্ঠার রায়ের আসল অংশটা পড়তে সময় লাগল আট মিনিট। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার স্বপ্ন দেখা শশিকলাকে জেলে পাঠানোর রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট।
‘আম্মা’ জয়ললিতার মৃত্যুর ২৬ দিনের মাথায় এডিএমকে-র সাধারণ সম্পাদক হন ‘চিন্নাম্মা’ শশিকলা। জয়ললিতার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনীর পরবর্তী লক্ষ্য ছিল তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর গদি। সেই আশায় ছাই ফেলে আজ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগে চার বছরের জন্য জেলে যেতে হবে শশিকলা এবং তাঁর পরিবারের দুই সদস্য ভি এন সুধাকরন এবং জে ইলাবরসি-কে। সঙ্গে মাথা পিছু ১০ কোটি টাকার জরিমানা। সুধাকরন শশিকলার বোনপো, ইলাবরসি তাঁর বৌদি। শশিকলাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। একটি সূত্রের মতে, স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে চার সপ্তাহ সময় চাইবেন শশী। যদিও অন্য সূত্র বলছে, কালই আত্মসমর্পণ করবেন তিনি।
শশি ইতিমধ্যেই ছ’মাস জেল খেটেছেন। আরও সাড়ে তিন বছর জেল খাটতে হবে তাঁকে। কিন্তু আইন অনুযায়ী, ওই কারাবাস এবং তা শেষ হওয়ার পরে আরও ছয় বছর, অর্থাৎ আগামী সাড়ে ন’বছর তিনি ভোটে লড়তে পারবেন না। ফলে বিধায়ক হয়ে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার আশা দূর অস্ত্। এডিএমকে নেতা এম থাম্বিদুরাই বলেছেন, তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে ফের শীর্ষ আদালতে আবেদন করবেন। আবেদন গৃহীত হলে তা তিন সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চে যাবে। প্রবীণ আইনজীবীরা অবশ্য মনে করছেন, সে পথে সুরাহার আশা খুবই কম।
জয়ার প্রথম দফার শাসনকালে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি মামলায় বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালত জয়া, শশিকলা ও অন্য দু’জনকে দোষী সাব্যস্ত করে চার জনকেই চার বছরের কারাদণ্ড দেয়। বাকিদের জন্য ১০ কোটি টাকার জরিমানা হলেও জয়ার ক্ষেত্রে তার পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকা। ২০১৪-র সেপ্টেম্বরের ওই রায়ের ধাক্কাতেই মুখ্যমন্ত্রীর গদি ছাড়তে হয় জয়াকে। কিন্তু ২০১৫-র মে মাসে জয়ললিতা, শশী-সহ চার জনকেই বেকসুর খালাস করে কর্নাটক হাইকোর্ট। গদিতে ফেরেন আম্মা।
আজ হাইকোর্টের রায় খারিজ করে নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল রেখেছে বিচারপতি ঘোষের বেঞ্চ। রায় বলছে, সমস্ত প্রমাণ অনুযায়ী, জয়ললিতা, শশিকলা ও অন্যরা দুর্নীতির অপরাধে দোষী। চার জনে ষড়যন্ত্র করে বিপুল বেআইনি সম্পত্তি করেছিলেন। পরে জয়ললিতা তা বাকিদের মধ্যে ভাগ
করে দেন। যাতে তাঁর নিজের গায়ে আঁচ না লাগে। কিন্তু জয়ললিতার সঙ্গে বাকি তিন অভিযুক্তের ‘অবিচ্ছেদ্য আঁতাত’ প্রমাণিত। জয়ললিতা মারা গিয়েছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার অস্তিত্ব থাকছে না। কিন্তু বাকিদের দোষী সাব্যস্ত করা ও শাস্তি সম্পর্কে নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল থাকছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, দুই বিচারপতির এ দিনের কাজটা সহজ ছিল না। কারণ এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত এমন একজন, যিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী নন। তামিলনাড়ুর লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘আম্মা’। লোকে তাঁর জন্য গায়ে আগুন দেয়। অন্য জন, সেই আম্মার ঘনিষ্ঠ সহচরী। মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার। তিনি তামিলনাড়ুর শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়কের নেত্রী। কিন্তু এ সবকে গুরুত্ব না দিয়ে আজ আইনের পথে হেঁটেই রায় দিয়েছেন দুই বাঙালি বিচারপতি। রায় দিতে গিয়ে তাঁদের বক্তব্য, বিশেষ আদালতের বিচারক মাইকেল কুনহা যে ভাবে বেআইনি সম্পত্তির হিসেব কষেছিলেন, সেটাই ঠিক। কর্নাটক হাইকোর্ট যে হিসেব কষেছিল, তাতে বেআইনি সম্পত্তির পরিমাণ কমে যায়। সুপ্রিম কোর্টের মতে, এই হিসেবনিকেশে হাইকোর্টের নাক গলানোর প্রয়োজন ছিল না।
আরও পড়ুন:
অস্তশশীর কুশলী চালে আপাতত পিছিয়ে পনীর
বিধায়ক-বন্দির দুর্গে এখন ভাঙা হাট
আচার্য বলেন, ‘‘এই রায় থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও রাজনীতিকদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। বিশেষ আদালতের সে দিনের বিচারক কুনহা এখন কর্নাটক হাইকোর্টের বিচারপতি। আজ তাঁরও জয় হল।’’
বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ আজ এজলাসে হাজির হয়ে ৫৭০ পৃষ্ঠার রায় খুলে বলেন, ‘‘বুঝতেই পারছেন বিরাট রায়। আমরা এই বোঝা নিয়েছি।’’ বিচারপতি অমিতাভ রায় জানান, তিনি বিচারপতি ঘোষের সঙ্গে সব বিষয়েই একমত। কিন্তু এই রায়ের পরিপূরক হিসেবে একটি সাত পৃষ্ঠার নিজস্ব রায় দিচ্ছেন। দুর্নীতি কী ভাবে অভিশাপ হয়ে উঠছে, ওই রায়ে তা বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
প্রায় ২০ বছর আগে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী এই দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। আজ রায়ের পর তিনি বলেন, ‘‘আমি জানতাম, এই বিচারপতিদের বেঞ্চ পুরো মামলা খতিয়ে দেখে বিস্তারিত রায় দেবেন। প্রমাণ হল, যে দলই দুর্নীতি করুক, আদালত কড়া অবস্থানই নেবে। বিচারপতি অমিতাভ রায় যে ভাবে সমাজে দুর্নীতির অভিশাপ নিয়ে পৃথক ভাবে মত প্রকাশ করেছেন, তাতেও আমি অভিভূত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy