পুলিশ কমিশনার পদে নেই, অথচ শিনা বরা খুনের তদন্তে আছেন— এমন হাঁসজারু অবস্থা রাকেশ মারিয়া মেনে নিতে চাইছেন না। অন্তত বুধবার নিজের ঘনিষ্ঠ মহলে সেই রকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে চিঠি দিয়ে এই তদন্ত চালিয়ে যেতে বলেছে। সে ক্ষেত্রে মারিয়াও আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করবেন কি না, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
নির্ধারিত সময়ের বাইশ দিন আগেই যে ভাবে আচমকা তাঁকে পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে সরতে হল, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি নন মারিয়া। এমনকী তিনি ইস্তফা দেবেন কি না, তাই নিয়েও জল্পনা চলছিল কোনও কোনও মহলে। বুধবার মারিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ইস্তফা দেওয়ার কথা তিনি ভাবছেন না। কিন্তু একই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি জানান, ডিজি (হোমগার্ড) পদে থেকে শিনা বরা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এই কথাটা তিনি সামনাসামনি বললেন না কেন? মারিয়া-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল, বিকেল অবধি সরকার মারিয়াকে লিখিত ভাবে শিনা-তদন্তের ভার ন্যস্ত করেনি। ফলে মারিয়ার পক্ষেও এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলাটা সমীচীন নয়।
পরিস্থিতিটা কিছুটা বদলে যায় সন্ধের পরে। কারণ সরকার তখন মারিয়াকে চিঠি দিয়ে জানায়, শিনা খুনের তদন্তভার তাঁরই থাকছে। মহারাষ্ট্র সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী রাম শিন্ডে নিজে সংবাদসংস্থা পিটিআইকে বলেন, ‘‘রাকেশ মারিয়াকে সরকারি ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, শিনা-তদন্তের তত্ত্বাবধান তিনিই করবেন। এই মামলার ক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসাররা কেবল রাকেশ মারিয়াকেই রিপোর্ট করবেন।’’ এই চিঠি পাওয়ার পরে মারিয়াকেও এ বার আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর অবস্থান জানাতে হবে। তিনি যদি তদন্ত চালাতে না চান, সে কথা তাঁকেই স্পষ্ট করে বলতে হবে। অর্থাৎ বল এখন মারিয়ার কোর্টে।
মঙ্গলবার দুপুরে মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার পদ থেকে রাকেশ মারিয়াকে সরিয়ে ডিজি (হোমগার্ড) করা হয়। শিনা-তদন্তের মাঝপথে এমন ঘোষণাকে ঘিরে তুমুল আলোড়ন পড়ে যায়। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে, বিজেপির ঘরের লোক নন বলেই মারিয়াকে সরতে হল কি না। এমনকী শিনা-তদন্তে মারিয়ার অতি সক্রিয়তায় কর্পোরেট স্বার্থে ঘা লাগছে বলে অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা। চাপের মুখে সন্ধেবেলা মহারাষ্ট্র সরকার ঘোষণা করে, শিনা-তদন্তের ভার রাকেশ মারিয়ার হাতেই থাকছে। কিন্তু মহারাষ্ট্র পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, আপাত দৃষ্টিতে পশ্চাদপসরণ বলে মনে হলেও সরকার খুব বুঝেসুঝেই এমন পদক্ষেপ করেছে। কারণ তারা বিলক্ষণ জানে যে, পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে সরে যাওয়ার পর রাকেশ মারিয়ার পক্ষে ওই তদন্ত চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে। ফলে আপাতত মারিয়াকে তদন্তের দায়িত্বে রেখে দিয়ে সরকার দেখাতে চাইল যে, জনমত ও সংবাদমাধ্যমের চাপকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে। এ বার মারিয়া নিজে থেকেই তদন্তভার নিতে অসম্মত হলে সরকার বলবে, এ ক্ষেত্রে তাদের কী করার আছে! তাতে সাপও মরবে, আবার লাঠিও ভাঙবে না!
মারিয়ার ঘনিষ্ঠদেরও বক্তব্য, সরকার এক ধরনের ক্ষমতাহীন দায়িত্ব মারিয়ার ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে এবং মারিয়া সেটা বুঝতে পেরেছেন। ফলে তিনি আর শিনা-তদন্তের সঙ্গে সংস্রব রাখবেন না। সরকারি চিঠি পাওয়ার পরেও মারিয়ার মত বদলায়নি বলেই ওই ঘনিষ্ঠদের দাবি। যদিও মারিয়া নিজে প্রকাশ্যে এখনও কিছু বলেননি।
কেন ডিজি (হোমগার্ড) পদে থেকে শিনা-তদন্ত চালানো যায় না বলে মনে করছেন মারিয়া? পুলিশ মহলের বক্তব্য—
এক, শিনা মামলা রুজু হয়েছে মুম্বই পুলিশ কমিশনারেটের অন্তর্গত খার থানায়। রাকেশ মারিয়ার অধীনে তদন্তকারী দল এক থাকলেও আখেরে তাঁদের পরিকাঠামোগত বহু বিষয়ে নির্ভর করতে হবে মুম্বই পুলিশের উপর। কোথাও অভিযান চালাতে মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনারের অধীন থানার সহযোগিতা চাইতে হবে।
দুই, রাকেশ মারিয়া ডিজি (হোমগার্ড) পদে সরে গেলেও শিনা মামলার তদন্তকারী দলের সদস্যরা মুম্বই পুলিশ কমিশনারেটেই আছেন। শুধু এই তদন্তের ক্ষেত্রেই মারিয়া তাঁদের কর্তা, কিন্তু বাকি সব দিক থেকে তাঁরা মুম্বই পুলিশ কমিশনারের অধীন। কাজেই মারিয়া তাঁদের যে রকমই নির্দেশ দিন, পুলিশ কমিশনার বা তাঁর অনুগত অফিসারদের চটিয়ে ওই দলের কাজ করা মুশকিল।
তিন, পুলিশ যেমন সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন। হোমগার্ড ও তার ডিজি-র নিয়ন্ত্রক অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতর। মারিয়া একই সঙ্গে দু’টি দফতরের অধীনে কাজ করবেন কী করে।
চার, নতুন পুলিশ কমিশনার আহমেদ জাভেদের সঙ্গে রাকেশ মারিয়ার সম্পর্ক ভাল নয়। ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে ১৯৮১-র আইপিএস রাকেশ মারিয়াকে যখন পুলিশ কমিশনার পদে বসানো হয়, এক ব্যাচ সিনিয়র জাভেদ প্রকাশ্যে তাঁর অসন্তোষ ও হতাশার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। ফলে শিনা তদন্তে মারিয়ার সঙ্গে তিনি কতটা সহযোগিতা করবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে।
পাঁচ, ডিজি (হোমগার্ড) পদে সরে গিয়েও যদি রাকেশ তদন্ত চালিয়ে যান, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই মামলাটিতে তাঁর কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে।
প্রাক্তন পুলিশ কর্তারাও এই সব সমস্যার কথা উ়ড়িয়ে দিচ্ছেন না। ২০০০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত মুম্বই পুলিশের কমিশনার পদে থাকা মহেন্দ্রনারায়ণ সিংহের কথায়, ‘‘মুম্বই পুলিশের উপরে রাকেশ মারিয়ার কোনও প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকছে না। এখন মারিয়া তদন্তের স্বার্থে কোনও অফিসারকে ডেকে পাঠালে তিনি অবলীলায় বলে দিতে পারবেন, ‘স্যার, আমার আজ আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ডিউটি রয়েছে।’ আসলে রাকেশকে অপমান করার জন্যই এমনটা করা হল।’’
অথচ মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার থেকে ডিজি (হোমগার্ড) পদে রাকেশ মারিয়ার বদলি খাতায়-কলমে পদোন্নতি। কারণ, মারিয়া এডিজি থেকে ডিজি পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন। কিন্তু এই পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। নির্দিষ্ট সময়ের ২২ দিন আগেই কারও পদোন্নতি সরকার করাতে পারে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। তবে পুলিশ সূত্রের খবর, সরকার চাইলে আগাম পদোন্নতির ক্ষেত্রে অসুবিধে নেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অনুমোদিত এবং ইউপিএসসি-র ধার্য ডিজি পদমর্যাদার অফিসারের সংখ্যা বেশি হচ্ছে বলে তিন মাসের মধ্যে তার অনুমোদন করাতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনও হচ্ছে না, কারণ ৩০ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রে ডিজি পদমর্যাদার এক জন অফিসার অবসর নেওয়ায় একটি জায়গা এমনিতেই খালি হয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy