প্রায় ৪৫ বছর আগের একটা সময়ের কথা মনে পড়ছে।
উত্তাল সময়। ইসলামাবাদের কবল থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রাম চলছে। তাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। প্রথম থেকেই ঘোষিত মিত্র পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে পাকিস্তানের পরাজয় দেখে বিশাল নৌবহর পাঠিয়ে দিল ওয়াশিংটন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান যাতে ইসলামাবাদের হাত থেকে বেদখল না হয়, তা নিশ্চিত করতে বঙ্গোপসাগরে ঢুকেও পড়েছিল মার্কিন নৌবহর। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিয়ে রুশ নৌবহরও ভারতীয় উপকূলের দিকে রওনা হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে আর জড়ায়নি বৃহৎ শক্তি। কিন্তু অসীম তিক্ততা জমে গিয়েছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চওড়া ফাটলটার মাঝে।
আজ ৭ জুন, ২০১৬ তারিখে বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে, তেমন একটা দিন ছিল। ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আজ এত রঙিন, মনে হচ্ছে সাড়ে চার দশক আগের ঘটনা বলে যেটা মনে পড়ছে, সেটা সম্ভবত একটা সাদা-কালো দুঃস্বপ্ন ছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবার আমেরিকা সফরে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে এই সম্ভবত তাঁর শেষ বৈঠক। ওবামার শাসনকাল শেষ লগ্নে পৌঁছেছে। এর পর কখনও দেখা হলে ওবামার সঙ্গে দেখা হবে, প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে নয়। এই বৈঠক তাই এক দিকে ওবামাকে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর বৈঠক। অন্য দিকে, গত দু’বছরে মোদী-ওবামা যুগলবন্দিতে দু’দেশের সম্পর্ক যে নতুন দিগন্তে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে আরও কয়েক পা এগিয়ে দেওয়ার বৈঠক।
অভূতপূর্ব এক সন্ধিক্ষণে এই দ্বিপাক্ষিক সন্ধি। হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নেওয়ার বেলা যখন আসন্ন, তখন কোনও এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে— অপূর্ণ যতটুকু এখনও, সেটুকুকেও খানিকটা এগিয়ে রাখা যাক। সে ডাকে সাড়া দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পৌঁছচ্ছেন সাত সাগরের ওপারে। ভারত-মার্কিন সম্পর্কে এমন ‘সন্ধি’ক্ষণ আগে আসেনি।
এনএসজি-র দরজা ভারতের জন্য খুলে দিতে তৎপর এই আমেরিকা। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রক দেশগুলির সংগঠনে দিল্লির প্রবেশ নিশ্চিত করতে উদগ্রীব এই ওয়াশিংটন। মোদীর দেশের জন্য আরও অনেক কিছু করতে উৎসাহে টগবগে ওবামার মুলুক। বিনিময়ে এশীয় জলভাগের সুবিশাল বিস্তারে ভারতের নৌবহরকে পাশে পেতে চাইছে মার্কিন নৌসেনা।
এই মার্কিন নৌসেনাই হানা দিয়েছিল বাংলার সাগরে ভারতীয় নৌসেনাকে জব্দ করতে! এই আমেরিকার নৌবহরই প্রশান্ত সাগর পেরিয়ে, হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছিল পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে!
আসলে বিষয়টা শুধু সামরিক নয়। এই সন্ধি এক বৃহৎ ও সুস্থাপিত গণতন্ত্রের সঙ্গে আর এক বৃহৎ ও সুস্থাপিত গণতন্ত্রের। চারপাশের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র এবং সংবিধানের কাঠামো বার বার টালমাটাল। সে সবের কোনও আঁচ গায়ে না মেখে প্রায় সাত দশক মাথা উঁচু ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের। আমেরিকার বুঝতে ভুল হয়নি, এশিয়ায় স্বাভাবিক মিত্র ভারতই হতে পারে।
আশা রাখছি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এই নতুন দিগন্তরেখায় আরও উজ্জ্বল একটা সকাল দেখা দেবে প্রধানমন্ত্রী মোদী আর প্রেসিডেন্ট ওবামার বহুচর্চিত শেষ বৈঠকের পর। সে সকালে শুধু পারস্পরিক সমৃদ্ধির ছটা থাকবে। একটা নরম রোদ থাকবে। ‘শত্রু’নাশের তাগিদ থেকে হাত মেলানোর তাপ থাকবে না এই সকালের রোদটায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy