বাড়ির পুজোর প্রতিমাতেও থিমের স্পর্শ। —নিজস্ব চিত্র।
একান্নবর্তী উত্সবের টান প্রবাসেও অক্ষুণ্ণ। কর্মব্যস্ত রাজধানীতেও শিকড়ের খোঁজে বাঙ্গালিরা মাতেন পারিবারিক দুর্গাপুজোয়। তবে পারিবারিক পুজো বলতেই যেন ধুসর এক ইতিহাসের ছবি ভেসে ওঠে চালচিত্র জুড়ে, দিল্লিতে কিন্তু তার বিপরীত ছবিটাও রয়েছে।
আসলে ক্রমশ পরমাণু-পরিবার হয়ে যাওয়ার নিঃসঙ্গতা বোধ হয়তো বা জন্ম দিচ্ছে বাড়িতে শারোদত্সব করে যুথবদ্ধ আনন্দ-ইচ্ছার। দেখা যাচ্ছে, দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়ির পুজোগুলি বয়সে অনেকটাই নবীন। পুজো দালানের ঠাট বাট না থাকলেও তা আন্তরিকতায় কম নয়।
এ রকমই দুটি পুজো যেন এ বারে বাড়ির পুজোর থিম এঁকে দিয়েছে। যার মধ্যে প্রথমটি চিত্তরঞ্জন পার্কের বি ব্লকের শান্তনু গুহরায়ের বাড়ির পুজো। মুড়ি, মুড়কির বৈকালিক ভোগ দিয়ে শুরু হওয়া এই পুজো এ বছর ১১ বছরে পড়ল। “কোনও দিনই বাড়িতে পুজোর কোনও চল ছিল না। আমার মা মারা যাওয়ার পর আমরা সবাই তাঁর অভাব বোধ করতে থাকি। সেই জায়গা থেকেই হঠাৎ বাড়িতে পুজো করার ইচ্ছে হয়”- জানালেন শান্তনুবাবু। বাড়ির পুজোর প্রতিমা বলতে সাধারণত একচালার শোলা বা ডাকের সাজের ছবি ভেসে উঠলেও এই পুজো প্রতিমা থিম অনুসারে হয়। শান্তনু বাবুর কথায়, “প্রথম বছর আর গত বছর সাবেকী প্রতিমা হলেও এ বছর আমরা থিমের পুজোয় ফিরে গিয়েছি।” দিল্লির বেশির ভাগ পুজো সাবেকি ভাবেই হয় বলে, আর তা ছাড়া থিমের পুজোয় প্রতিমার অভিনবত্ব বেশি থাকে বলেই থিমের পুজো করেন বলে জানালেন তিনি।
বাড়ির পুজোয় কলাবউ বরণ। দিল্লিতে। —নিজস্ব চিত্র।
তাঁদের এ বছরের প্রতিমার অভিনবত্ব হল দুর্গার হাতে। আট হাত এক দিকে আর বাকি দুই হাত অন্য দিকে। অসুরেও আছে বৈচিত্র। মানুষ রূপী অসুরের মধ্যে থেকে আরও কিছু অসুরের অংশ বেরোচ্ছে। থিমের বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানান, শিল্পী সনাতন দিন্দার তৈরি একটি পুরনো প্রতিমা থেকেই এ বারের পুজোর থিম তৈরি হয়েছে।
বাড়ির পুজো হিসাবে শুরু হলেও প্রতিবেশীদের উদ্দীপনায় আর অংশগ্রহণে এই পুজো কিন্তু কার্যত পাড়ার পুজোয় পরিণত হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব পাড়ার সবাই মিলে চার দিন সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত লোক সমাগম হয়। এই বাড়ির পুজোর উদ্যোক্তাদের কথায়, “এখানে কারও কোনও বাধা নেই। যে যখন ইচ্ছে এসে পুজো দিতে পারেন, ভোগ নিতে পারেন। পুজোর কোনও কিছুতে অংশগ্রহণ করতে চাইলে বা পুজোয় কিছু দিতে চাইলে সবাইকে খোলা মনে স্বাগত জানাই”।
বাঙালির পুজো মানে সঙ্গে গান বাজনা থাকবেই। তাও বাদ পড়েনি এখানে। পুজোর সময় বন্ধুবান্ধব মিলে গানে, বাজনায়, আড্ডায় সন্ধের আসর জমে ওঠে। সঙ্গে থাকে পুরানো বাংলা সিনেমা দেখাবার ব্যবস্থা। সাদা কালোয় উত্তম সুচিত্রার নস্টালজিয়া।
চিত্তরঞ্জন পার্কের বি ব্লকেই হয় আরেকটি বাড়ির পুজো। অনিরুদ্ধ হোমচৌধুরীর বাড়ির এই পুজো শুরু হয় ২০০৮ সালে। এখানে অবশ্য প্রতিমা সাবেকি একচালার শোলার সাজেরই হয়। পুজো শুরুর প্রসঙ্গে বাড়ির প্রবীণ সদস্যা সতী হোমচৌধুরী জানান, “২০০৮ সালে হঠাৎই আমার ছেলেমেয়ের উৎসাহে পুজো শুরু হয়। প্রথমে বাড়ির কয়েক জনই এই পুজোয় অংশগ্রহণ করতেন। এখন পাড়ার সবাই সামিল হয় এই পুজোয়”।
আরও পড়ুন: স্বচ্ছ ভারত অভিযানের কোপ দিল্লির পুজো বাজেটে
এখানে রোজ মালপোয়া, পাটিসাপটা প্রভৃতি বাড়িতে তৈরি মিষ্টি পুজোয় দেওয়া হয়। সেই মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়াটিও যেন উত্সবের একটা অঙ্গ। পুজো প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অনিরুদ্ধ বাবু জানান, “আমাদের পুজোর নবপত্রিকার জন্য যে নয় রকমের গাছ লাগে তা কলকাতা থেকে আনানো হয়। কলাবৌকে বাড়ির মেয়ে হিসাবে দশমীর দিন বিদায় দেওয়া হয়। বাড়ির ভেতরে কলাবৌ এনে তাঁকে ঘিরে বিবাহিত মহিলারা গান গাইতে গাইতে প্রদক্ষিণ করেন। বিয়ের পর মেয়ে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় যে সমস্ত নিয়ম পালন করা হয় এক্ষেত্রেও তাই করা হয়।”
বাড়ির পুজো হিসাবে প্রাচীনত্বের দাবি না রাখলেও রাজধানীর এই দুই বাড়ির পুজোই নিজ নিজ স্বাতন্ত্রের দাবি তো রাখেই। দুই পুজোই আন্তরিকতা আর আতিথ্যে দিল্লির মানুষের মন জয় করে ফেলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy