Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

চাপে পড়েই কি তদন্তে গা-ছাড়া রায়গড় পুলিশ

জঙ্গলের মধ্যে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল মানুষের পোড়া দেহাংশ। তার পরেও কোনও খুনের মামলা করেনি রায়গড় পুলিশ। নিদেনপক্ষে একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা পর্যন্ত রুজু হয়নি। প্রশ্ন হল, কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৩
Share: Save:

জঙ্গলের মধ্যে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল মানুষের পোড়া দেহাংশ। তার পরেও কোনও খুনের মামলা করেনি রায়গড় পুলিশ। নিদেনপক্ষে একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা পর্যন্ত রুজু হয়নি।

প্রশ্ন হল, কেন?

কারণ যা-ই হোক, ২০১২-য় পুলিশের এই গাফিলতির অভিযোগ আজ মেনে নিলেন রায়গড়ের এসপি মহম্মদ সুভেজ হক। আর তার পরেই শিনা বরা খুনের রহস্য ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগটা আরও জোরালো ভাবে উঠল রায়গ়ড় পুলিশের বিরুদ্ধে (কারণ, সংবাদমাধ্যমের দৌলতে খবরটা আগে থেকেই ঘুরছিল)। ২০১২-য় রায়গড়ের পুলিশ সুপার যিনি ছিলেন, সেই আর ডি শিন্দের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কোঙ্কন রেঞ্জের আইজি প্রশান্ত বুর্দে।

ফলে মুম্বই, কলকাতা, গুয়াহাটি হয়ে তদন্তের অভিমুখ ফিরল সেই রায়গড়েই। স্থানীয় সূত্রে পাওয়া খবরের ওপর ভিত্তি করেই ২০১২-র ২৩ মে পেন তালুকের জঙ্গল থেকে কিছু পোড়া দেহাংশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে শিনার দেহ সেখানেই পুঁতে রাখা হয়েছিল বলে ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের গাড়ির চালক শ্যাম রাই। সূত্রের বক্তব্য, সে বার দেহাংশ উদ্ধারের সময় পাঁচ জন স্থানীয় সাক্ষীর উপস্থিতিতে প্রাথমিক একটি রিপোর্ট (পঞ্চনামা) তৈরি করেছিল পুলিশ। দু’দিন পরে সেই দেহাংশ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল মুম্বইয়ের জে জে হাসপাতালে। কিন্তু এর পরেই বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। পুলিশের দাবি, হাসপাতাল কোনও রিপোর্ট পাঠায়নি। কিন্তু পুলিশ কি উদ্যোগী হয়ে সেই রিপোর্ট তলব করেছিল? উত্তর নেই।


মুম্বইয়ে খার থানার পথে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। ছবি: পিটিআই।

রায়গড়ের এসপি-র কাছে আজ জানতে চাওয়া হয়, পুলিশের উপরে কি কোনও চাপ ছিল? কেন ধামাচাপা পড়ল তদন্ত? চলতি বছরের গোড়ায় এসপি-র দায়িত্ব নেওয়া সুভেজ বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। আমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই।’’ তবে প্রাথমিক একটি তদন্ত রিপোর্ট ইতিমধ্যেই উপরমহলে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুভেজ। মহারাষ্ট্র পুলিশের ডিজি সঞ্জীব দয়াল জানয়েছেন, শিনা খুনের তদন্তে গাফিলতি কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা প্রমাণিত হলে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। সংশ্লিষ্ট অফিসারদের সঙ্গে কথা

বলে বিষয়টি জানতে চাওয়া হচ্ছে বলে সূত্রের খবর।

তবে মুম্বই পুলিশের দাবি, শিনাকে খুনের দিন যে গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটির হদিস মিলেছে। ওই গাড়ির ডিকিতে করেই তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে অনুমান। এক অফিসার বলেন, ‘‘শিনাকে খুনের পরেই ইন্দ্রাণী ওই গাড়িটি বিক্রি করে দেন। সেই ডিলারেরও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। তবে গত তিন বছরে গাড়িটি বহু বার হাতবদল হয়েছে। আমরা সেটি উদ্ধার করব।’’ আপাতত ঠিক হয়েছে, তিন মূল অভিযুক্ত শ্যাম, ইন্দ্রাণী ও তাঁর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খন্নাকে রায়গড়ের ওই ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হবে। তিন জনের ফোনের কল ডিটেলসও জোগাড় হয়েছে।

গত কাল শ্যামকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে মাথার খুলি-সহ আরও কিছু দেহাংশ উদ্ধার করেছিল মুম্বই পুলিশ। ঠিক কোথায় দেহটি পুঁতে রাখা হয়েছিল, মুম্বই পুলিশকে তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় হেতেভনে গ্রামের গণেশ ধেনে নামে এক ব্যক্তি। ২০১১ থেকেই ‘পুলিশ পাটিল’ (পুলিশের গ্রামীণ নজরদার) হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। ২০১২-য় ওই দেহাংশ যখন উদ্ধার হয়, সেই সময়ে ঘটনাস্থলে ছিলেন গণেশ। ওই দেহাংশ শিনার কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আজ তাঁর ভাই মিখাইল বরা এবং মা ইন্দ্রাণীর কাছ থেকে নমুনা নেওয়া হয়।

আজ সন্ধ্যায় বান্দ্রার একটি হোটেলে মিখাইলের মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হয় শিনার প্রেমিক রাহুল মুখোপাধ্যায়কে। দু’জনের কাছ থেকেই বেশ কিছু নতুন তথ্য উঠে এসেছে বলে পুলিশ সূত্রের দাবি। গত কাল খার থানায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় মিখাইল বলেছিলেন, খুনের দিন, অর্থাৎ ২০১২-র ২৪ এপ্রিল মুম্বইয়েই ছিলেন তিনি। তদন্তেও জানা গিয়েছে, সঞ্জীব কলকাতা থেকে মুম্বইয়ে এসেছিলেন আগের দিন, ২৩ এপ্রিল। উঠেছিলেন ওরলির একটি বিলাসবহুল হোটেলে। ২৪ এপ্রিল একাধিক বার তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয় ইন্দ্রাণীর। মিখাইল সে দিন একই হোটেলে ছিলেন বলে খবর। সূত্রের দাবি, পুলিশকে মিখাইল জানিয়েছেন, সম্পত্তি নিয়ে আলোচনার জন্যই তাঁকে মুম্বইয়ে ডেকে পাঠান ইন্দ্রাণী। আবার অন্য একটি সূত্রের দাবি, শিনা-রাহুলের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার নাম করে ছেলেকে ডেকেছিলেন ইন্দ্রাণী। যা-ই হোক, পুলিশের সন্দেহ, ওই হোটেলেই শিনা-হত্যার ছক কষা হয়।

তবে মিখাইল দাবি করেছেন, ২৪ এপ্রিল রাতে শিনার সঙ্গে তাঁকেও খুনের পরিকল্পনা ছিল সঞ্জীব-ইন্দ্রাণীর। এবং পুলিশ সূত্র বলছে, মিখাইলকে খুনের পরিকল্পনার কথা জেরায় স্বীকার করেছেন সঞ্জীবও। এমনকী শ্যাম রাইও বলেছেন, মিখাইলকেও যে মারা হতে পারে, এমন কিছু একটা তিনি আঁচ করেছিলেন।

মিখাইলের দাবি, সে দিন হোটেলে তাঁকে পানীয় দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। সেটি খাওয়ার পর থেকেই তাঁর মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। তিনি বুঝতে পারেন, পানীয়তে কিছু মেশানো রয়েছে। ইতিমধ্যে ইন্দ্রাণী বলেন, তাঁরা শিনাকে নিয়ে আসছেন। সঞ্জীব-ইন্দ্রাণী বেরিয়ে যেতেই মিখাইল হোটেল ছেড়ে পালান। ও দিকে, ইন্দ্রাণীরা তখন শিনাকে ফোন করে ডেকে গাড়িতে তুলে তাঁকে খুন করেন। শিনাকে গাড়িতে মাদক মেশানো জল খাইয়ে অচেতন করে তার পর গলা টিপে মারা হয়েছিল বলে পুলিশের সন্দেহ। মিখাইলের দাবি, শিনাকে মারার পর একই কায়দায় তাঁকেও মেরে ফেলতেন ইন্দ্রাণীরা।

সে ক্ষেত্রে দু’টো প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, পিটার মুখোপাধ্যায় সেই সময় কর্মসূত্রে ইউরোপে ছিলেন। ‘গোপন আলোচনা’র জন্য নিজের ফাঁকা বাংলো ছেড়ে ইন্দ্রাণী হোটেলে গেলেন কেন? আবার, তাঁকে মারার চেষ্টা হচ্ছে বুঝেও মিখাইল কেন তখনই পুলিশের কাছে গেলেন না?

এক আত্মীয় ইতিমধ্যেই দাবি করেছেন, শিনার মৃত্যুর ১৩ দিন পর পর ইন্দ্রাণীর চাপেই দিদির অফিসে পদত্যাগপত্র ই-মেল করেছিলেন মিখাইল। আবার শিনার বাড়িওয়ালাকে তিনিই চিঠিতে জানিয়েছিলেন, শিনা বাড়ি ছাড়তে চান। কিন্তু কেন এই মেল করলেন মিখাইল? আত্মীয়টির দাবি, ইন্দ্রাণী হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর কথামতো কাজ না করলে মিখাইলকে আর তিনি হাতখরচ দেবেন না। মিখাইলের বক্তব্য, শিনার বিদেশে চলে যাওয়ার কথাই তাঁকে বারবার বুঝিয়ে এসেছেন ইন্দ্রাণী। এমনকী তাঁকে আর মুম্বই আসতেও বারণ করে দিয়েছিলেন। মিখাইল কি তখনও কিছু আঁচ করেননি? তা হলে কেন তিনি বলেছিলেন, ইন্দ্রাণী দোষ স্বীকার না করলে ৩১ অগস্ট আরও অনেক প্রমাণ তিনি পুলিশের হাতে তুলে দেবেন? থাকছে ধোঁয়াশা।

ধোঁয়াশা বাড়িয়েছেন রাহুলও। গত কাল রাহুলের দেহরাদূনের বাড়ি থেকেই শিনার পাসপোর্ট উদ্ধার করে পুলিশ। মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া বলেছিলেন, শিনা যে আদৌ বিদেশে যাননি, ওই পাসপোর্টই তার প্রমাণ। প্রশ্ন হল, রাহুল কেন আগ বাড়িয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে এই পাসপোর্টের কথা জানাননি? রাহুলের দাবি, ইন্দ্রাণী তাঁকে বলেছিলেন, অন্য একটি পাসপোর্ট নিয়ে শিনা বিদেশে পড়তে গিয়েছেন। গত কাল জেরায় পুলিশকে তিনি তেমনই জানিয়েছেন বলে সূত্রের খবর। রাহুল বলেন, শিনার নামে নিখোঁজ ডায়েরি করতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ তাঁকে আমল না দিয়ে ইন্দ্রাণীর কথাই মেনে নিয়েছিল। গত কাল পুলিশ জানতে চায়, শিনার প্রেমিক হিসেবে রাহুল কি ব্যাপারটা নিয়ে আরও লেগে থাকতে পারতেন না? রাহুলের দাবি, তাঁর আর মাথা কাজ করছিল না। আর ইন্দ্রাণীও তাঁকে থানা-পুলিশ না করতে চাপ দিচ্ছিলেন। পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, রাহুল জানিয়েছেন, ২০১১-য় দেহরাদূনেই তাঁর ও শিনার বাগ্‌দান হয়ে গিয়েছিল। ইন্দ্রাণী অবশ্য সেখানে ছিলেন না। ইন্দ্রাণীর অন্য দুই স্বামী— সঞ্জীব বা সিদ্ধার্থ দাসকে তিনি চিনতেন না বলেও দাবি রাহুলের।

মূল প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখনও অধরা। কেন খুন হলেন শিনা? রাহুলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ইন্দ্রাণীর আক্রোশ, নাকি টাকাপয়সা নিয়ে বিবাদ? পুলিশ সূত্রেও এখনও তার কোনও ইঙ্গিত নেই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE