বেশ কয়েক মাসের শৈত্য ছেড়ে গত দু’দিন নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে সৌজন্য এবং মৈত্রীর উষ্ণতা দেখেছে রাজ্য রাজনীতি। নানা মহলেই প্রবল জল্পনা, এখান থেকেই কি তবে সব বিবাদের শেষ? এ বার শুধুই সমঝোতা? এমন জল্পনার আবহ কাটাতে সোমবার সেই জমি বিলকেই ঢাল করলেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক বিলে প্রথমে বিরোধিতা করেও পরে সংসদে সেই বিল পাশে সহযোগিতাই করে চলেছে তৃণমূল। যা থেকে রাজনৈতিক শিবিরে ধারণা তৈরি হয়েছে, সংসদে বিল পাশে কেন্দ্রকে সহযোগিতা করার বিনিময়ে সারদার মতো মামলায় নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছে রাজ্যের শাসক দল। পশ্চিমবঙ্গ সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সৌহার্দ্য দেখে এবং মোদীর মুখে রাজ্য সরকারের কোনও সমালোচনা না শুনে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছিলেন, এ বার কি তবে জমি বিলেও সুর নরম করবে তৃণমূল? কার্যক্ষেত্রে লোকসভায় অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। জমি বিল নিয়ে তাঁরা কোনও রফার পথে যাবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং মমতাও। পুরুলিয়ায় প্রশাসনিক বৈঠক সেরে বাঁকুড়া রওনা হওয়ার আগে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, জমি বিল নিয়ে আগের অবস্থান থেকে কি সরে আসবেন? মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘‘সরে আসব কেন? এটা নিয়েই তো লড়াই করছি! জমি বিল নিয়ে ‘নো কম্প্রোমাইজ’!’’
ভবিষ্যতে তৃণমূল-বিজেপি’র সমীকরণ যে দিকেই মোড় নিক, লোকসভায় এ দিন শুরু থেকেই মোদী সরকারের জমি বিলের বিরোধিতা করেছে মমতার দল। তৃণমূলের তরফে প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় জানান, আগাগোড়া এই কৃষক-বিরোধী বিলের বিরোধিতা করে এসেছেন তাঁরা। সিঙ্গুর আন্দোলনে তাঁর দলের অবস্থানের কথা তুলে ধরে সৌগতবাবু লোকসভায় জানিয়েছেন, জমি বিলটি বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই তৈরি। তাঁর কথায়, ‘‘এই বিলে সামাজিক নিরাপত্তা সম্পর্কে কোনও আশ্বাস নেই। খাদ্য নিরাপত্তার কথাও বলা হয়নি কোথাও।’’ পরে লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ২০১৩ সালে একমাত্র তৃণমূলই ইউপিএ-র আনা জমি বিলের বিরোধিতা করেছিল। তাঁর বক্তব্য, এই বিলে কৃষকদের মত প্রকাশের কোনও সুযোগই থাকছে না। বাম এবং কংগ্রেস নেতারা অবশ্য বলছেন, লোকসভায় বিজেপি-র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তাই জমি বিলে তৃণমূলের অবস্থান কী থাকে, তার চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে রাজ্যসভাতেই।
তৃণমূল নেতৃত্বও বুঝতে পারছেন, লোকসভা ভোটের আগে থেকে মোদী-সহ বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদগার (কখনও কখনও শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে অসংসদীয় শব্দ প্রয়োগও) করে আসার পরে হঠাৎ ‘সৌজন্য ও সাংবিধানিক কর্তব্যে’র মোড়কে প্রধানমন্ত্রীর দিকে মৈত্রীর হাত সমঝোতার বার্তাই দেবে জনমানসে। রাজ্য বিজেপি-র একাংশেরও একই আশঙ্কা। এমতাবস্থায় জমি বিলকেই ‘দূরত্ব’ বোঝানোর সূচক হিসাবে দেখাতে চাইছেন দু’দলের নেতৃত্ব।
দূরত্বের সব ফলক মুছে যায়নি বলেই তৃণমূল-বিজেপি সম্পর্ক নিয়ে আরও দেখেশুনে পা ফেলতে চাইছেন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এ দিনও কটাক্ষ করেছেন, ‘‘একটা দল আরএসএসের মদতে পুষ্ট, আর এক দল জামাতের আশীর্বাদপ্রাপ্ত! উপর তলায় বন্ধুত্ব করলেও নীচু তলায় তারা কিন্তু সাম্প্রদায়িক মেরুকরণই চাইবে। তাই বাংলার ভবিষ্যৎ অন্ধকার!’’ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানও বলেছেন, ‘‘এখন তো আমরা তৃণমূলকে বিজেপি-র বি টিম বলতে পারি!’’ কিন্তু কংগ্রেসের মতো এখনই রাস্তায় নেমে তৃণমূল-বিজেপি দোস্তি নিয়ে হইচই করার পক্ষপাতী নন সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব।
দলের অন্দরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যুক্তি, রাজ্য সরকারে যারাই থাকুক, প্রধানমন্ত্রীর জন্য তাদের সৌজন্য ও কর্তব্য পালন করতেই হতো। তাই শুধু প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ থেকেই কোনও সিদ্ধান্তে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক নয়। বরং আসন্ন ভবিষ্যতে কী হয়, তার দিকে নজর রাখতে হবে। সারদা মামলার গতিপ্রকৃতি খেয়াল রাখতে হবে। তত দিন কিছু বিবৃতি, কিছু কটাক্ষ চলতে পারে। তার বেশি কিছু নয়। বামেদেরই একাংশ অবশ্য চাইছে, মমতা-মোদী নতুন সমীকরণকে এখনই জোরদার প্রচারে এনে সংখ্যালঘু মন জয়ের চেষ্টা করা হোক। দিনের শেষে তাই মমতার মতোই ভারসাম্যের রাজনীতি মাথায় রাখতে হচ্ছে বুদ্ধবাবুদেরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy