অচ্ছে দিনের আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদী সরকারের আড়াই বছর পরে শিল্পমহলের অভিযোগ, গর্ব করার মতো নতুন বিনিয়োগ এখনও অধরা। হোঁচট খাচ্ছে কারখানার উৎপাদন বাড়ার সূচক। আর্থিক সংস্কারের হাত ধরে ব্যবসার পথ সহজ করার দাবি অনেকটাই ঢাক পেটানো। এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিতে দীপাবলির রোশনাই আনতে সরকারের সবেধন নীলমণি সেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হাতে জমে থাকা বিপুল অর্থ লগ্নি করে অর্থনীতির চাকায় গতি আনতে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। না-পারলে নিদেনপক্ষে বাড়তি হারে ডিভিডেন্ড দিতে হবে সরকারকে। দু’দিন আগেই বিভিন্ন মন্ত্রকের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মোদী। সেখানে তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বিপুল নগদ নিয়ে বসে রয়েছে। অথচ তা নতুন লগ্নি হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। মোদী সচিবদের নির্দেশ দেন, হয় এই অর্থ নতুন কারখানা তৈরিতে লগ্নি করতে হবে। অথবা অন্য কোনও উপায়ে কাজে লাগাতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের উপকার হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ, মোদী উন্নয়নে আতসবাজির আলো ছড়ানোর কথা বললেও, সচিবদের হাতে ধরিয়ে রেখেছেন সেই টিমটিমে মোমবাতি। না-হয়েছে আর্থিক সংস্কার, না-তৈরি হয়েছে লগ্নির সহায়ক পরিবেশ তৈরির স্পষ্ট নীতি।
প্রধানমন্ত্রীর অস্থিরতা অবশ্য অযৌক্তিক নয়। কারণ, হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও মোদীর রাজত্বে বেসরকারি লগ্নিতে গতি আসেনি। পরিকাঠামোর পিছনে সরকারি অর্থ ঢেলেই বৃদ্ধির হার ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন মোদী ও তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। গত সপ্তাহেই ইনদওরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সম্মেলনে জেটলি ফের বলেছেন, ‘‘সাধারণত লগ্নির হিসেবে শিল্পমহল সরকারের থেকে এগিয়ে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের এমন এক মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে, যেখানে বেসরকারি বিনিয়োগ সরকারি লগ্নির থেকে পিছিয়ে। আমরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি।’’ নয়া লগ্নির পক্ষে জেটলির যুক্তি, মূল্যবৃদ্ধির হার কমায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়েছে। এ বছর বর্ষা ভাল হওয়ায় মূল বাজার এবং গ্রামে চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। শিল্পমহল অবশ্য এই যুক্তি মানছে না। তাদের বক্তব্য, চাহিদা না-থাকায় চালু কারখানাগুলিতেই ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি, লগ্নির সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরও পথ হাঁটতে হবে সরকারকে। যার অন্যতম জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন।
মোদী সরকার সহজে ব্যবসা করার পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে অনেক কাজ হয়েছে বলে ঢাক পেটালেও বাস্তবটা যে ভিন্ন, বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট সেই ছবিই তুলে ধরেছে। ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ নিয়ে এ বছরের রিপোর্টে, গোটা বিশ্বের ক্রম-তালিকায় ভারত মাত্র এক ধাপ এগিয়ে ১৩০তম স্থানে আসতে পেরেছে। অথচ মোদীর দাবি ছিল ২০১৮ সালের মধ্যেই প্রথম ৫০টি দেশের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারবে ভারত। বিশ্বব্যাঙ্কের মতে, এর কারণ, ভারতে আর্থিক সংস্কার এখনও নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই সীমিত। তাই বিশ্বব্যাঙ্ক শিল্পে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার সময় ও খরচ কমানোর প্রশংসা করলেও সেই সাফল্য ভারতকে তালিকার আরও উপরে নিয়ে যেতে পারেনি। উল্টে ব্যবসা শুরু করা, নির্মাণ-কাজের অনুমতি পাওয়া বা ঋণ জোগাড় করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে অন্যদের তুলনায় আরও কয়েক ধাপ করে নীচে নেমে গিয়েছে।
মোদী সরকার অবশ্য অনুযোগ করছে, বিশ্বব্যাঙ্কের চোখে অনেক কাজই ধরা পড়েনি। তাদের দাবি, আগামী বছর ভারতের পক্ষে তালিকায় অনেক উপরে উঠে আসা সম্ভব হবে। কারণ তত দিনে চালু হবে পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি), সহজে সংস্থা গুটিয়ে নেওয়ার পথ প্রশস্ত করতে রূপায়িত হবে দেউলিয়া আইন, প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনে আনা হবে সুস্পষ্ট নীতি, সম্পূর্ণ হবে অনলাইনে কর জমার ব্যবস্থা।
ক্রমতালিকায় ভারত এগোবে কিনা, তার জেরে বেসরকারি লগ্নির পরিমাণ বাড়বে কিনা, এই প্রশ্নের জবাব আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে। এই মুহূর্তে অর্থনীতির হাল ধরে রাখতে মোদীর ভরসা সেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। তা সে লগ্নির অভাব পূরণই হোক বা রাজকোষ ঘাটতি মেটানো। অর্থ মন্ত্রক নির্দেশ দিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি যদি যথেষ্ট নতুন লগ্নি না-করে, তা হলে আরও বেশি হারে ডিভিডেন্ড দিতে হবে। চলতি অর্থবর্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ডিভিডেন্ড থেকে ৫৩,৮৮৩ কোটি টাকা আয়ের আশা করছে অর্থ মন্ত্রক। রাজকোষের ঘাটতি মেটাতে গত আর্থিক বছরে বাজেটের আগে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে ৩০ শতাংশ হারে ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। বাজেটে জেটলি তা বাধ্যতামূলক করে দেন। তার আগে ডিভিডেন্ডের সাধারণ হার ছিল ২০ শতাংশ। শুধু গ্যাস বা তেল সংস্থাগুলিই ৩০ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিতে পারে বলে আশা করা হতো।
এর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বেচেও আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্র। নীতি আয়োগ সুপারিশ করেছিল, কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সিংহভাগ শেয়ার বেচে দিয়ে সরকারি মালিকানা ৫০ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনা হোক। অন্য কয়েকটি সংস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে বাকি শেয়ার বেচে দেওয়া হোক। চলতি আর্থিক বছরে বিলগ্নিকরণ থেকে ৫৬,৫০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য নিয়েছেন জেটলি। প্রথম ছ’মাসে ২১ হাজার কোটি টাকা ঘরে এসেছে। কিন্তু শেয়ার বাজার যথেষ্ট তেজি না হলে বিলগ্নিকরণের লক্ষ্য পূরণ হবে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে।
তবে বিনিয়োগ করার মতো টাকা রয়েছে যে সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার, তারা শিল্পে লগ্নি করুক— এটাই আপাতত মোদীর ইচ্ছা। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্তাদের প্রশ্ন হল, যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলিই এগিয়ে আসছে না, সেখানে তাঁরা কোন যুক্তিতে নতুন লগ্নি করবেন! অর্থনীতির ‘অচ্ছে দিন’ আনতে মরিয়া মোদী সরকার অবশ্য সেই যুক্তিতে কান দিতে নারাজ।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব
• রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির হাতে থাকা অর্থ শিল্পে লগ্নি
• লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা থেকে আরও ডিভিডেন্ড আদায়
• অলাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণ
• কিছু ক্ষেত্রে সংস্থার শেয়ার বেচে যৌথ উদ্যোগে আয়বৃদ্ধি
• রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ পরিচালনার ভার লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে দেওয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy