পটনায় মমতা। ছবি: শ্যামলী দে।
উপলক্ষ নীতীশকুমারের শপথগ্রহণ। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই শুরু হতে পারে বিজেপি-বিরোধী জোটের সলতে পাকানোর কাজ।
আগামিকাল দুপুর দুটোয় পটনার বিখ্যাত গাঁধী ময়দানের অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের যে তালিকা আজ প্রকাশ করেছে রাজ্য প্রশাসন, সেটাই উস্কে দিয়েছে এমন সম্ভাবনার জল্পনা। শপথ অনুষ্ঠান এবং তার পরে প্রথামাফিক রাজ্যপালের দেওয়া চা-চক্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন থাকবেন, তেমনই থাকবেন কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গাঁধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব, এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার, সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
মুখ্যমন্ত্রী পদে নীতীশকুমারের পঞ্চমবার শপথগ্রহণের আগের দিন পটনা জুড়ে সাজসাজ রব। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হবে জনসভার ধাঁচে। এ বারের অনুষ্ঠান ঘিরে জেডিইউ, আরজেডি এবং কংগ্রেস—মহাজোটের তিন শরিকের উন্মাদনা স্বাভাবিক। দেড় বছর আগের লোকসভা ভোটে বিজেপির কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে বিধানসভায় বিপুল ভাবে ফিরে আসতে পারার কারণে। আর নীতীশকুমার তৃপ্ত তাঁর ঘোষিত শত্রু নরেন্দ্র মোদীকে মুখের উপর জবাব দিতে পেরে। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধী জোট তৈরির সম্ভাবনা। অনেকেই বলছেন, সময়টা উপযুক্ত। কারণ, অসহিষ্ণুতা বিতর্কে বিজেপি এখন বেশ কোণঠাসা। বিহারের ফল তাদের আরও বিপাকে ফেলে দিয়েছে। সুতরাং কাল পাটলিপুত্রে মমতা, নীতীশ, লালুপ্রসাদ, রাহুলদের আলোচনায় বিজেপি-বিরোধী জাতীয় রাজনীতির বীজ যদি বপন হয়ে যায়, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সম্ভাব্য সেই জোট আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছেন মমতা। নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে সঙ্গে নিয়ে আজই পটনায় পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে চা-চক্র নিয়ে একপ্রস্ত আলোচনাও সেরে ফেলেছেন নীতীশ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘মমতা তো শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, তিনি গোটা দেশের জনপ্রিয় নেত্রী।’’ কেন্দ্র-রাজ্য সম্পদ বণ্টনের প্রশ্নে সম্প্রতি গোটা দেশের হয়েই প্রতিবাদ করেছেন মমতা। সামাজিক প্রকল্পগুলিতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমানো নিয়ে আপত্তি তুলে মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন ডাকার দাবি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যাকে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রথম ধাপ বলে দাবি করছে তৃণমূলের অন্দরমহল। মমতা নিজে অবশ্য বলছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু বলার নেই। কিন্তু রাজ্যের প্রতি যে অবিচার হচ্ছে, মানুষের স্বার্থেই তার প্রতিবাদ প্রয়োজন। সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলন ডাকার দাবি জানিয়েছি।’’
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীদের আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। কিন্তু মমতা এবং ত্রিপুরার মানিক সরকার ছাড়া আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীই তাতে সামিল হননি। রাজ্যে ভোটের কারণে যেতে পারবেন না জানিয়ে সমর্থন বার্তা পাঠিয়েছিলেন নীতীশ। কিন্তু বিহারের ভোটের ফল সব ছবিটাই পাল্টে দিয়েছে বলে মনে করছেন জাতীয় রাজনীতির কারবারিরা। তাঁদের মতে, বিরোধী নেতাদের একজোট হওয়ার আগ্রহ এখন অনেক বেশি।
সেই জোটের কারিগর হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার আগ্রহ মমতার যেমন রয়েছে, তেমনই আগ্রহী নীতীশকুমারও। এ দিন তাঁর সরকারের দেওয়া অতিথি তালিকা থেকেই নীতীশের রাজনীতির অভিমুখ স্পষ্ট হয়েছে বলে অনেকের মত। গতকাল নীতীশ নিজে ফোন করে মোদীকে শপথ অনুষ্ঠানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মোদী আসতে না পারলেও বেঙ্কাইয়া নায়ডু এবং রাজীবপ্রতাপ রুড়িকে পটনা যেতে বলেছেন। কিন্তু এই দুজনেরই নাম নেই সরকারি অতিথি তালিকায়। নাম নেই বিজেপি শিবিরে নীতীশের দুই ‘বন্ধু’ অরুণ জেটলি এবং সুশীল কুমারেরও। সুতরাং বিজেপি-কে যে নীতীশ দূরে রাখছেন সেটা স্পষ্ট। তিনি প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না বটে, কিন্তু জেডিইউ শিবিরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তাঁর ইচ্ছার কথা। আগামিকালের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একটা নতুন ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা হোক, এমনটাই চাইছেন নীতীশ। আর সেই ফ্রন্টের সূত্র ধরে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চান জেডিইউ নেতারা।
সে ক্ষেত্রে লালু কী করবেন? নীতীশের সঙ্গে তাঁর অভ্যন্তরীণ সূক্ষ্ম লড়াই থাকলেও আরজেডি নেতা জানেন, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে শাস্তি পাওয়ার পরে তাঁর প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়া অসম্ভব। আদালতের রায়ে ভোটে প্রার্থী হওয়াই আটকে গিয়েছে তাঁর। ফলে বিহারে যেমন নীতীশকে মুখ্যমন্ত্রী পদ ছেড়ে দিয়েছেন তিনি, তেমনই দিল্লিতেও কাঁটা হয়ে দাঁড়াবেন না বলেই জেডিইউ নেতারা আশাবাদী।
কিন্তু লোকসভা ভোটের তো এখন অনেক দেরি। প্রায় সাড়ে তিন বছর. তার আগে অ-বিজেপি দলগুলিকে কাছাকাছি আনতে জেডিইউ নেতা শরদ যাদব প্রস্তাব দিয়েছেন, বিরোধী নেতারা সবাই মিলে একটা যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করুন। সেই কর্মসূচিকে আপাতত সংসদের কাজকর্মের মধ্যেও সীমাবদ্ধ রাখা যায়। সংসদের বিভিন্ন ঘটনাবলিতে অ-বিজেপি দলগুলি কী ভাবে কাজ করবে তার একটা নির্দেশিকা তৈরি করতে আগ্রহী নীতীশ এবং মমতা। মুলায়ম সিংহ যাদব বিহারের ভোটে নীতীশ-লালুর সঙ্গী না হলেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তিনিও এমন মঞ্চে সামিল হতে চাইছেন। এ নিয়ে কথা বলতে দু’দিন আগে মমতাকে ফোনও করেছিলেন মুলায়ম।
৭ ডিসেম্বর দিল্লিতে অরুণ জেটলির মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন মমতা। তখন সংসদের সেন্ট্রাল হলেও যেতে পারেন তিনি। ভবিষ্যতের রণকৌশল ঠিক করতে আলোচনা করতে পারেন বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে। অনেকেই মনে করছেন, এ সবের মধ্য দিয়ে মোদী-বিরোধী রাজনীতির সলতে পাকানোর কাজটা দ্রুত এগোচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপি কী করবে? বিহারের ফল যা-ই হোক, সেই রাজ্যের প্রতি যে তিনি কোনও অসূয়া পোষণ করছেন না, তার ইঙ্গিত গত কালই দিয়েছেন মোদী। রাজ্যে দীর্ঘদিন আটকে থাকা সেতু প্রকল্পে ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। রাজধানীর রাজনীতিকদের মতে, এর মধ্যে দিয়ে এক দিকে নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিশ্বাসী এক জন রাষ্ট্রনেতা, অন্য দিকে উন্নয়নমুখী প্রশাসক হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন মোদী।
বিজেপি শিবির বলছে, গত কাল নীতীশের ফোন পাওয়ার পরে পটনা যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন মোদী। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করে তাঁকে নিরস্ত করেছে দল। আগামিকাল পটনায় যদি সত্যি সত্যিই বিজেপি-বিরোধী কোনও জোটের বীজ অঙ্কুরিত হয়, তখন মোদী কী করেন সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy