পুলিশের সঙ্গে কথা বলে থানা থেকে বেরোচ্ছেন পিটার মুখোপাধ্যায়। শুক্রবারই প্রথম পুলিশের মুখোমুখি তিনি। ছবি: পি টি আই।
এক সন্তানকে নিজের হাতে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। সেই খুনের ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে মুখোমুখি বসলেন অন্য সন্তান।
শুক্রবার রাতের খার থানা। শিনা বরা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের সামনে পুলিশ হাজির করল তাঁর ছেলে মিখাইলকে। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে এই মামলায় অন্য দুই অভিযুক্ত সঞ্জীব খন্না এবং শ্যাম মনোহর রাইকেও সেখানে রাখা হয়। মিখাইলের বক্তব্যের সঙ্গে ওই তিন জনের বয়ানের কোথায় মিল, কোথায় তফাৎ, সেটা দেখতে চাইছিল পুলিশ। একই ভাবে আগের দিন শিনার প্রেমিক রাহুল মুখোপাধ্যায়কেও তারা তিন জনের মুখোমুখি হাজির করেছিল। তার পরে আজ দিনের বেলা ইন্দ্রাণীদের বেশ কিছু ক্ষণের জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেটা কোথায়, তা অবশ্য জানানো হয়নি।
তবে আজ আদালতের রায়ে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেয়েছেন তাঁর আইনজীবী। পুলিশ তাঁর মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছে না, এই অভিযোগ তুলে গত কাল আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা মেনেই আইনজীবীর সঙ্গে অভিযুক্তকে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হোক বলে আজ রায় দেয় আদালত।
এ দিন সকালেই আদালতে পেশ করা হয় ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খন্নাকেও। আগের দিন তাঁকে কলকাতা থেকে মুম্বই আনা হয়েছিল। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁর ল্যাপটপ, মোবাইল এবং পাসপোর্ট। হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে আজ সকালে তাঁকে বান্দ্রার আদালতে পেশ করে পুলিশ। আর্জি মেনেছে আদালত। ৩১ অগস্ট পর্যন্ত মুম্বই পুলিশের হেফাজতেই থাকবেন সঞ্জীব।
প্রাথমিক জেরাতেই শ্যাম ও সঞ্জীবের বয়ানে অসঙ্গতি পেয়েছে পুলিশ। তাদের অভিযোগ, শিনা-হত্যায় প্রত্যক্ষ ভাবেই জড়িত ছিলেন সঞ্জীব। পুলিশ জানিয়েছে, ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে মুম্বই আসেন সঞ্জীব। ২৪ তারিখ খুন হন শিনা। সঞ্জীব ফেরার বিমান ধরেন খুনের ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল। ধরা পড়ার পরে সঞ্জীব প্রথমে দাবি করেছিলেন, খুনের সময় তিনি গাড়িতে বসে ঘুমোচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তা মানতে চায়নি। এ দিন রাতে মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া জানান, শেষ পর্যন্ত জেরার মুখে সঞ্জীব এই খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
শিনা বরা (ডান দিকে) হত্যাকাণ্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পরে খার থানা থেকে বেরিয়ে আসছেন
পিটার মুখোপাধ্যায়ের প্রাক্তন স্ত্রী শবনম এবং ছেলে রাহুল। বৃহস্পতিবার রাতে মুম্বইয়ে।
ছবি: পি টি আই ও ফাইল চিত্র।
তবে এই তিন জনের বাইরেও আর কেউ খুনের সঙ্গে জড়িত কি না, সেটা খুঁজে দেখা হচ্ছে। আজই প্রথম বার প্রাক্তন টিভি ব্যারন পিটার মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাই গৌতমকে ডেকে পাঠায় পুলিশ। পিটারকে প্রায় ৩০ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, পিটার একটি চার পাতার বয়ান পুলিশের কাছে জমা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি গ্রহণ করা হয়নি। পিটারের ছেলে রাহুল এবং প্রাক্তন স্ত্রী শবনমও গত কাল খার থানায় এসে পুলিশের সঙ্গে দেখা করে যান। দেহরাদূনে শবনমের পরিবারের তরফে আগেই জানানো হয়েছিল যে, শিনার সঙ্গে রাহুলের সম্পর্কের কথা তাঁরা জানতেন। দু’জনের বিয়ের ব্যাপারে তাঁদের পূর্ণ সম্মতিও ছিল।
রাকেশ মারিয়া এ দিন এও জানিয়েছেন যে, দেহরাদূন থেকেই শিনার পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। তবে রাহুলের বাড়ি থেকেই সেটি পাওয়া গিয়েছে কি না, তা তিনি বলেননি। যদিও শিনার এক বান্ধবীর দাবি, ওটা রাহুলের বাড়ি থেকেই পাওয়া গিয়েছে। ওই বান্ধবী বিয়ের পরে দেহরাদূনেই থাকেন। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২০১১ সালে গুয়াহাটি গিয়েছিলেন শিনা। সে বার গিয়ে বন্ধুদের কাছে রাহুলের সঙ্গে তাঁর আসন্ন বিয়ের কথাও বলেন। ওই বান্ধবীর অভিযোগ, সে বার গুয়াহাটি থেকে ফেরার পরেই শিনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায়। শিনাকে রিহ্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রিহ্যাবে যাওয়ার আগে বান্ধবীর কাছে ফোন করে শিনা সাহায্য চেয়েছিলেন বলেও তাঁর দাবি। এবং তাঁর প্রশ্ন, রাহুলের কাছে যদি শিনার পাসপোর্ট থেকে থাকে, তা হলে শিনার আমেরিকা যাওয়ার ‘ভুয়ো’ খবর শুনেও রাহুল চুপ করে ছিলেন কেন?
শিনার আর এক বন্ধুও রিহ্যাব-পর্বটির কথা বলেছেন। শিনাকে ছাড়ানোর জন্য মিখাইল তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন বলেও দাবি করেছেন। তবে মিখাইল নিজে এখনও এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।
এ দিন সকালেই গুয়াহাটি থেকে মুম্বই নিয়ে আসা হয় মিখাইল-কে। মুম্বই পুলিশ তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। শিনা হত্যা মামলায় ইন্দ্রাণী গ্রেফতার হওয়ার পরেই মিখাইল দাবি করেছিলেন, ‘‘বোনকে মা-ই মেরেছে। মা পারে না এমন কাজ নেই।’’ বলেছিলেন, তাঁর কাছে যা তথ্যপ্রমাণ আছে, সে সব তিনি পুলিশকে দেবেন। বৃহস্পতিবার মুম্বই পুলিশের একটি দল গুয়াহাটি গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিল। তার পরেই ঠিক হয়, মিখাইল মুম্বই যাবেন। এ দিন সকালের উড়ানে মুম্বই পৌঁছন তিনি। জানিয়েছেন, নিহত বোনের মুখ চেয়ে এর শেষ দেখে ছাড়বেন। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি ইতিমধ্যেই তিনি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে রাকেশ জানিয়েছেন।
খুনের বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে শিনার নাম করে তাঁর অফিসে যে ই-মেল যায় এবং বাড়িভাড়া সংক্রান্ত একটি দলিলেও তাঁর যে সই জাল করা হয়, তার পিছনে কে ছিলেন, সেটাও জানা গিয়েছে বলে রাকেশ মারিয়ার দাবি। তবে তার নাম তিনি বলেননি।
২০১২ সালের মে মাসে পুলিশ রায়গড়ের জঙ্গল থেকে যে অজ্ঞাতপরিচয় দেহটি উদ্ধার করেছিল, সেটিই শিনার দেহ বলে অনুমান করে তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন। ওই দেহটি সে সময় জে জে হাসপাতালের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। মৃতের বয়স, লিঙ্গ এবং মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু জানা যায় কি না, তা পরীক্ষা
করে দেখার কথা ছিল। কিন্তু সেই রিপোর্ট তার পর থেকে ওই হাসপাতালেই পড়েছিল। এত দিন পরে সেটি সংগ্রহ করা হয়েছে। যদিও হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে, ওই রিপোর্টে তেমন কোনও তথ্য নেই। পরীক্ষা সম্পূর্ণ করার পরে হাসপাতালের তরফে ওই দেহ ফের রায়গড়ের জঙ্গলেই পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। এ দিন সেখানে ফের গিয়ে মাটি খোঁড়ে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে কিছু হাড়গোড়, মাথার খুলি এবং একটি স্যুটকেস উদ্ধার হয়। হাসপাতাল থেকেও আরও কিছু দেহাবশেষ সংগ্রহ করা হয়েছে। এই রায়গড়ের পেন তালুক এলাকাতেই খুন হন শিনা। এর মধ্যে পেন তালুকে গিয়ে মাটি খুঁড়েও অল্প কিছু দেহাংশ পেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু সেটা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট ছিল না। এ দিন নতুন করে খননের পরে যা পাওয়া গেল, তার ভিত্তিতে ডিএনএ পরীক্ষা চালানোর চেষ্টা হবে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy