পদ্মনাভ বালকৃষ্ণ আচার্য ও তরুণ গগৈ
জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) সংশোধনী নিয়ে অসম সরকারের বিপরীত মেরুতে রাজ্যপাল!
আজ মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ সাংবাদিক বৈঠকে ঘোষণা করেন— ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নাগরিক পঞ্জী তৈরি করা হোক। কিন্তু রাজ্যপাল পি বি আচার্য জানিয়েছেন, ভোটার তালিকা কখনও নাগরিক পঞ্জীর ভিত্তি হতে পারে না। কারণ ভোটার তালিকায় অনেক বিদেশির নাম থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিন রাজ্য বিজেপিও ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরির বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়।
এ দিকে, বড়ো ভাষায় এনআরসি ফর্ম বিলির দাবিতে বিক্ষোভে নেমেছে আবসু। এনআরসির জন্য নির্দিষ্ট ‘লিগ্যাসি ডেটা’ চা বাগানগুলিতে মিলছে না। প্রতিবাদে আগামী কাল বাগানগুলিতে দু’ঘণ্টার প্রতীকী কর্মবিরতি ডেকেছে আটসা। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ দু’দিন আগে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, ভোটার তালিকার ভিত্তিতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি ঢেলে সাজানো উচিত। এ নিয়ে কেন্দ্রকে চিঠি দেবে রাজ্য।
বর্তমানে এনআরসি সংশোধনীর কাজ চলছে ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জী ও ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করে। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল এআইইউডিএফ ও বরাক উপত্যকার বিভিন্ন নাগরিক সুরক্ষা মঞ্চের দাবি, ১৯৫১ সালের এনআরসি ও ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকা অসম্পূর্ণ। এনআরসি ও ভোটার তালিকার সম্পূর্ণ প্রতিলিপিও উদ্ধার হয়নি। এনআরসি সেবাকেন্দ্রে সেই সব তথ্য অমিল। এমনকী, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার নামও ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জী বা ১৯৭১ সালের আগের কোনও ভোটার তালিকায় না থাকায় তাঁর ছেলে তথা বর্তমান বিধায়ক দেবব্রত শইকিয়াকে অন্য উপায়ে নাগরিক পঞ্জীতে নাম ওঠানোর জন্য আবেদন করতে হয়েছে।
এ দিন সাংবাদিক সম্মেলন করে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানান, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী এনআরসি তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে কেন্দ্রকে চিঠি দিচ্ছে রাজ্য সরকার। কারণ, ভোটার তালিকা সাধারণত বাংলাদেশি ও সন্দেহজনক ভোটারদের বাদ রেখে তৈরি করা হয়। সর্বশেষ ভোটার তালিকা অনেক পরিমার্জনের পরে তৈরি হয়েছে। তাই, ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের নাম এনআরসিতে স্বাভাবিক নিয়মে ওঠা উচিত। গগৈ জানান, বর্তমানে যে ১২টি প্রমাণের উপর ভিত্তি করে নাগরিকপঞ্জী সংশোধনীর কাজ চলছে, আরজিআই রাজ্যের পরামর্শ মেনে নিলে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকাও তাতে যুক্ত হবে। আসু, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি, এজেওয়াইসিপির মতো সংগঠনগুলির বক্তব্য, গগৈ রাজনৈতিক স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে জলঘোলা করছেন। সুপ্রিম কোর্টে এনআরসি নিয়ে মামলা চালানো অসম পাবলিক ওয়ার্কসের দাবি, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। তা হলে গগৈ কেন্দ্রকে চিঠি দিচ্ছেন কেন? শিলচরের সাংসদ সুস্মিতা দেব গগৈয়ের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘‘এ নিয়ে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিক।’’
প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর বরাক বিষয়ক উপদেষ্টা গৌতম রায়-সহ উপত্যকার চার কংগ্রেস বিধায়ক ও হোজাইয়ের বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী অর্ধেন্দু দে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নাগরিকপঞ্জী তৈরির দাবি তুলেছিলেন।
এ দিন গগৈ বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্র সরকার ও রেজিস্ট্রার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার কাছে সুপারিশ করবে। তার পর প্রয়োজনমতো সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে।’’ তিনি মেনে নেন, বরাকবাসীর দাবি সঠিক।
ঙ্গে বারবার মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়া রাজ্যপাল পদ্মনাভ বালকৃষ্ণ আচার্যের বিরুদ্ধে কংগ্রেস যখন রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে নাগরিক পঞ্জী নিয়েও মুখ্যমন্ত্রীর মতের বিরোধিতা করলেন আচার্য। তাঁর মতে, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা এনআরসির ভিত্তি হতে পারে না। কারণ, অসমের মানুষ দীর্ঘ দিন থেকেই অভিযোগ তুলেছেন, ভোটার তালিকাগুলিতে প্রচুর অনুপ্রবেশকারীর নাম রয়েছে। এনআরসি তৈরির উদ্দেশ্যে ভূমিপুত্রদের দাবি সুনিশ্চিত করা ও অসমে বিদেশিদের চিহ্নিত করা। কিন্তু, ভোটার তালিকা অনুযায়ী এনআরসি তৈরি হলে তা হবে না। রাজ্যপালের মতে, ১৯৭১ সালের পর যে সব ভারতীয় নাগরিক অসমে পাকাপাকি এসে বসবাস করছেন তাঁদেরও নাগরিকত্ব দাবি করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
রাজ্য বিজেপি অভিযোগ তোলে, ২০১৪ সালের ভোটার তালিকায় অবৈধ বিদেশিদের নাম রয়েছে। তার ভিত্তিতে এনআরসি গড়ার দাবি করা গগৈ আসলে অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছেন। গগৈ পাল্টা বলেন, ‘‘ওই ভোটার তালিকায় থাকা ভোটারদের ভোটেই বিজেপি সাংসদরা নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটারদের নিয়ে এত সন্দেহ থাকলে আগে সাংসদরা ইস্তফা দিন।’’ অন্য দিকে, এনআরসির জন্য প্রয়োজনীয় বংশবৃক্ষের তালিকা (লিগ্যাসি ডেটা) ও অন্যান্য প্রমাণপত্র চা বাগানগুলিতে না মেলায় আটসার নেতৃত্বে ১০টি সংগঠনের উদ্যোগে আগামী কাল রাজ্যের প্রায় ৮০০ চা বাগানের ২০ লক্ষ কর্মী দু’ঘণ্টা কর্মবিরতির পালন করতে চলেছেন। তাঁদের দাবি, চা বাগানগুলিতে শ্রমিকদের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি। তাঁদের কাছে বংশবৃক্ষের তালিকা নেই। ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জীতে বাগান শ্রমিকদের সিংহভাগের নাম অমিল। বর্তমান শ্রমিকদের কাছে চা সংস্থার দেওয়া পরিচয়পত্র থাকলেও, প্রাক্তন কর্মীদের কাছে কোনও প্রমাণ নেই। অথচ তাঁরা বংশানুক্রমে অসমের বাসিন্দা। এই অবস্থায় নাগরিক পঞ্জীতে বর্তমান ও প্রাক্তন চা শ্রমিকদের নাম তোলার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অসম চা মজদুর সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক দিলেশ্বর তাঁতি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী গগৈ ২০১৪ সালের ভোটার তালিকার ভিত্তিতে এনআরসি করার যে পরামর্শ দিয়েছেন তা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। না হলে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে প্রায় ১৫০ বছর ধরে অসমে বাস করা চা শ্রমিকরা নাগরিক হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy