Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
বিহারে গো-হারা

মোদী-রথ থামাল লালু-নীতীশ জুটি

সেই নব্বইয়ের দশকে, লালকৃষ্ণ আডবাণীর উত্থানের দিনে বিহারে তাঁর রথ আটকে দিয়েছিলেন লালু প্রসাদ যাদব। আর আজ পুরনো বন্ধু নীতীশ কুমারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থামিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদীর জয়যাত্রা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:০৯
Share: Save:

সেই নব্বইয়ের দশকে, লালকৃষ্ণ আডবাণীর উত্থানের দিনে বিহারে তাঁর রথ আটকে দিয়েছিলেন লালু প্রসাদ যাদব। আর আজ পুরনো বন্ধু নীতীশ কুমারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থামিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদীর জয়যাত্রা। লোকসভা ভোটে বিপুল জয়ের পর এই নিয়ে দ্বিতীয় বার মুখ থুবড়ে পড়ল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি। ন’মাস আগের দিল্লি বিধানসভা ভোটে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বিজেপি। বিহারের ফলাফলও কম চমকপ্রদ নয়। সরকার গড়ছিই বলে দাবি করে আসা বিজেপি কোনওক্রমে ২৪৩ আসনের বিধানসভার সিকি ভাগ দখল করতে পেরেছে।

এটা ঠিক যে অধিকাংশ বুথ-ফেরত সমীক্ষা এগিয়ে রেখেছিল লালু-নীতীশ জোটকে। কিন্তু জয়ের ফারাক যে এতটা হবে, তা আন্দাজ করতে পারেনি কেউ। প্রায় সকলেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিয়েছিল। আজ সকাল আটটায় ইভিএম খোলার পরে খানিকক্ষণ এগিয়েছিল বিজেপি। পটকা ফাটাও শুরু হয়ে গিয়েছিল দিল্লি-পটনায় দলীয় দফতরের সামনে। কিন্তু তার পর যতই সময় গড়িয়েছে, ততই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে আরজেডি-জেডিইউ-কংগ্রেস মহাজোট। দিনের শেষে তাদের ঝুলিতে ১৭৮টি আসন।

লালু, নীতীশ দু’জনের জন্যই এ বারের ভোট ছিল মরণবাঁচন লড়াই। গত লোকসভা ভোটে দু’জনকেই কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল মোদী-হাওয়া। রাজ্যের ৪০টি আসনের মধ্যে ৩১টিই পেয়েছিল বিজেপি। লালুর আরজেডি ৪টি, নীতীশের জেডিইউ মাত্র দু’টি। তখন অবশ্য লালু-নীতীশ জোট ছিল না। মোদীই তাঁদের কাছাকাছি আনলেন। এবং সৌহার্দ্য যে অস্তিত্ব রক্ষার উপায় হতে পারে, সেটা বোঝা গিয়েছিল ক’মাস পরের উপনির্বাচনে। আর তার পরেই যাবতীয় তিক্ততা ভুলে হাত মেলালেন দুই পুরনো বন্ধু। সেই মেলবন্ধনে কংগ্রেসের ভূমিকাও অবশ্য কম নয়।

তার পরেও লড়াইটা সহজ ছিল না। বিহার দখল করতে মরিয়া ছিলেন মোদী-অমিত। দু’মাস ধরে প্রায় একটানাই রাজ্যে ঘাঁটি গেড়েছিলেন বিজেপি সভাপতি। নিজের হাতে সাজিয়েছেন ভোট-যুদ্ধের যাবতীয় ঘুঁটি। তিরিশ বারের ওপর প্রচারসভা করতে এসেছেন মোদী নিজে। কোনও রাজ্যের ভোটে প্রধানমন্ত্রীর এত বার সভা করতে যাওয়া কার্যত নজিরবিহীন। সঙ্গে ছিল তৃণমূল স্তরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচার।

এই সব ঝড় সামলে মহাজোট যে বাজিমাত করল, তার কারণ খুঁজতে ইতিমধ্যেই কাটাছেঁড়া শুরু করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। উন্নয়ন, জাতপাত না ধর্মীয় মেরুকরণ— কোন অঙ্ক কাজে দিল, তা নিয়েই তোলপাড় রাজনীতির অলিন্দ।

বিহার দখলে দু’মুখো রণকৌশল নিয়েছিলেন মোদী-অমিত জুটি। প্রধানমন্ত্রী নিজে উন্নয়নের স্লোগানের বাইরে বিশেষ হাঁটেননি। যে স্লোগান হাতিয়ার করে লোকসভা ভোটে তাঁর বিপুল জয়। বিহারে এসে একের পর এক জনসভায় গত দশ বছরের জঙ্গল-রাজের কথা বলেছেন মোদী। ঘোষণা করেছেন লক্ষ কোটি টাকার উন্নয়নের প্যাকেজ। আর্জি জানিয়েছেন, আমাকে এক বার সুযোগ দিন, বিহারের হাল পাল্টে দেব। অন্য দিকে, বিজেপি নেতৃত্বের পরের ধাপ এবং নিচুতলা হাতিয়ার করেছিল ধর্মীয় মেরুকরণকে। সেখানে প্রচারের মূল বিষয় ছিল গো-রক্ষা, হিন্দু-জাগরণ।

অনেকে বলছেন, এ বারের ভোটে শেষ পর্যন্ত জাতপাতের রাজনীতিটাই থেকে গেল। উন্নয়নের স্লোগান বা ধর্মীয় মেরুকরণ দিয়ে তাকে ঢাকা গেল না। আর তার জেরেই দলগত আসন সংখ্যার নিরিখে এক ধাক্কায় তিন নম্বরে চলে গেল বিজেপি। বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, ফলাফল যা-ই হোক, বিহারে তাদের ভোটব্যাঙ্ক মোটামুটি অটুট রয়েছে। যদিও পরিসংখ্যান বলছে, লোকসভার থেকে তো বটেই, গত বিধানসভা ভোটের তুলনাতেও ৫ শতাংশের কাছাকাছি ভোট কমেছে বিজেপির। এ বার এনডিএ-র প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ৩৪.১ শতাংশ। মহাজোট তাদের থেকে ৭.৮ শতাংশ এগিয়ে রয়েছে। জাতপাতের পাটিগণিতেই মহাজোটের এই বাজিমাত বলে বিজেপির ওই সূত্রের দাবি।

এই ব্যাখ্যা আবার মানতে আপত্তি অনেকের। তাঁদের যুক্তি, উন্নয়নের প্রশ্নে নীতীশের গ্রহণযোগ্যতা কিছু কম নয়। তাঁর দশ বছরের শাসনকালে বিহারে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হয়েছে। অন্য দিকে, ১৭ মাস পরেও তেমন কিছু করে দেখাতে পারেননি মোদী। উল্টে পেঁয়াজ-ডালের মতো রোজকার জিনিসের দাম লাগামছাড়া হয়েছে। সুতরাং জাতপাত বড় ফ্যাক্টর হলেও বিজেপির ভরাডুবির একমাত্র কারণ নয়। কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদের কথায়, ‘‘মণ্ডলের রাজনীতিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে মহাজোট। এর সঙ্গে নীতীশের উন্নয়নের মডেলও যোগ হয়েছে। মোদী বিহারের জন্য লক্ষ কোটির প্যাকেজ ঘোষণা করলেও গত ১৭ মাসে বাস্তবে কোনও উন্নয়নের ছবি মেলে ধরতে পারেননি।’’

তবে ফলাফল প্রাথমিক ভাবে বিশ্লেষণের পরে মনে হচ্ছে যে, যাদব-কুর্মি ছাড়া অন্য পিছিয়ে পড়া জাতের ভোট তাদের বাক্সে আসবে, বিজেপির এই অঙ্ক শেষ পর্যন্ত মেলেনি। উল্টে ‘সংরক্ষণ নীতি খতিয়ে দেখা উচিত’, সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের এমন মন্তব্য ব্যুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। দাদরির ঘটনা সংখ্যালঘুদের যেমন মহাজোটের পতাকার তলায় একজোট করেছে, তেমনই উদারপন্থী হিন্দুদেরও বিজেপির থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। উচ্চগ্রামের প্রচারেও উল্টো ফল হয়েছে বলে মনে করছেন দলের অনেক নেতা। বিজেপি সাংসদ চন্দন মিত্র তো বলেই দিলেন, ‘‘ঢাকঢোল না-পিটিয়ে প্রচার, মৃদুভাষী নীতীশ কুমারকে তুলে ধরেই বাজিমাত করেছে মহাজোট। অমিত শাহের তৈরি করা অতি চড়া সুরের প্রচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে বিহারের মানুষ।’’

বিজেপি নেতাদের একাংশ অবশ্য আজ দাবি করছেন, পাটিগণিতের নিরিখে লালু-নীতীশ বরাবরই তাঁদের থেকে এগিয়ে ছিলেন। তাঁদের আশা ছিল এটাই যে, দুই নেতা তেলে-জলে মিশ খাবেন না। কিন্তু সেই আশা পূর্ণ হয়নি। আর তার কৃতিত্ব অনেকটাই কংগ্রেসের। গোড়ায় নীতীশের সঙ্গে হাত মেলানোর ব্যাপারে গড়িমসি করছিলেন লালু। সনিয়া গাঁধী তাঁর উপরে চাপ বাড়ান। একটা সময় দশ জনপথের দরজাও লালুর জন্য বন্ধ করে দেন তিনি। রাহুলও জানিয়ে দেন, লালু রাজি না হলে নীতীশের সঙ্গে একতরফা ভাবে আসন বণ্টন করে নেবে কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিতে লালুর সঙ্গে বরফ গলানোর কাজ শুরু করেন নীতীশ। প্রচার পর্বের মাঝেও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে মাঝরাতে লালুর বাড়িতে হাজির হয়েছেন তিনি। আজ ফল প্রকাশের পরে সোজা চলে গিয়েছেন আরজেডি দফতরে জোটসঙ্গীর সঙ্গে দেখা করতে।

লালুও সৌজন্য বজায় রেখেছেন আগাগোড়া। বিজেপি তাঁদের পুরনো ঝগড়া খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করলেও তিনি পাত্তা দেননি। ভোটের আগেই বলেছিলেন, নীতীশ জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী। আর আজ আরজেডি যখন জেডিইউয়ের থেকে নয় নয় করে ৯টি আসন বেশি পেয়েছে, তখনও লালুর ঘোষণা, নীতীশই মুখ্যমন্ত্রী হবেন। আর কাকার (নীতীশ) কাছে রাজনীতি শিখবেন সদ্য ভোটে জেতা তাঁর দুই ছেলে। ভবিষ্যতে কী হবে পরের কথা, নীতীশের আজ সুখের সংসার।

সেই সংসারের ছায়া জাতীয় রাজনীতিতে কতটা পড়বে, তা নিয়ে চিন্তায় বিজেপি নেতারা। এমনিতেই অসহিষ্ণুতা নিয়ে শাসক দল এবং সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। থমকে আর্থিক সংস্কার। ফলে সমালোচনায় মুখর শিল্পমহল। বিহারের ফলের জেরে বিরোধী আক্রমণ তীক্ষ্ণ হবে। মোদীর কেন্দ্র বারাণসীতে সভা করার কথা ঘোষণা করেছেন লালু। নীতীশও বলেছেন, এই ফলের প্রভাব বিহারের বাইরে পড়বে। ফলে সব মিলিয়ে মোদীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ বার প্রশ্ন উঠতে শুরু করবে বলেই অনেকের মত।

একদা বিহারের চম্পারণ থেকে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। জরুরি অবস্থার সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের হাত ধরেই দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই বিহারেই আজ মোদী-হাওয়া থামিয়েছেন জয়প্রকাশের দুই শিষ্য। পাল্টা হাওয়া দেশের অন্যত্র ছড়ায় কি না, সেটাই দেখার।

অন্য বিষয়গুলি:

modi lalu nitish bihar election bjp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE