বিএসএফের সঙ্গে সংঘর্ষে হত পাক জঙ্গি নোমান ওরফে মোমিন।
এ যেন দ্বিতীয় কসাব।
২৬/১১-র মুম্বইয়ে একের পর এক নাশকতা চালানোর পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল পাকিস্তানের লস্কর জঙ্গি আজমল কসাব। মারা গিয়েছিল তার সঙ্গী ইসমাইল। বুধবার জম্মুর উধমপুরে অনেকটা একই ভাবে বিএসএফের কনভয়ে হামলা চালানোর পরে জীবন্ত ধরা পড়ে গেল পাক জঙ্গি উসমান ওরফে কাসিম খান ওরফে নাভেদ। মারা গিয়েছে তার সঙ্গী নোমান ওরফে মোমিন নামে আর এক জঙ্গি।
ঘটনার সূত্রপাত আজ ভোরে। জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে সামরোলি এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল বিএসএফের একটি কনভয়। কনভয়টি আটকায় দুই জঙ্গি। হাতে ধরা এ কে ৪৭ থেকে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে তারা। ছোড়ে গ্রেনেডও। পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে বিএসএফ। দু’পক্ষের সংঘর্ষে প্রাণ হারান দুই কনস্টেবল। তাঁদের মধ্যে এক জন বাঙালি, নাম শুভেন্দু রায়। বিএসএফের পাল্টা গুলিতে মারা যায় এক জঙ্গিও। এর পরেই পালানোর চেষ্টা করে উসমান। সঙ্গে উধমপুরের পাঁচ বাসিন্দাকে রীতিমতো পণবন্দি করে নিয়ে গা-ঢাকা দেবার মতলবে ছিল সে। কিন্তু তার সেই চেষ্টায় জল ঢেলে দেন ওই পণবন্দিরাই। যাদের সে বন্দি করেছিল, তাদের হাতেই বন্দি হয় উসমান। তাকে ধরতে সফল
হয় পুলিশ।
ন’দিন আগেই পঞ্জাবের গুরদাসপুরে জঙ্গি হামলায় পাক যোগ মিলেছে বলে দাবি করেছে ভারত। কিন্তু তিন জঙ্গির কাউকেই জীবন্ত ধরা যায়নি সেখানে। গত কাল পাকিস্তানে পুলিশের প্রাক্তন শীর্ষ কর্তা তারিক খোসা কবুল করেন, ২৬/১১-র ছক পাকিস্তানের মাটিতেই কষা হয়েছিল। এরই মধ্যে আজ উধমপুরে হামলা এবং উসমান জীবন্ত ধরা পড়ায় সন্ত্রাসে পাক মদতের প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভারতের হাতে উঠে এল।
পুলিশের কাছে জেরায় এক-এক বার এক-এক রকম কথা বলেছে উসমান ওরফে নাভেদ ওরফে কাসিম। এই জন্যই তার তিনটি নামের কথা উল্লেখ করেছে পুলিশ। কখনও সে জানিয়েছে তার বয়স কুড়ি। পরে আবার বলেছে, সে ১৬ বছরের কিশোর। তার বাড়ি পাকিস্তানের ফয়সলাবাদে। ভারতে এসেছিলে কেন? হাসিমুখে নাভেদের জবাব, ‘‘মানুষ মারতে। এই কাজটা দারুণ লাগে আমার!’’ স্তম্ভিত পুলিশকর্তাদের সে সাফ বলেছে, ‘‘আমার সঙ্গী গুলির মুখে প্রাণ দিয়েছে। আমি পালিয়েছিলাম। আল্লার মর্জি হলে আমিও মরে যেতাম।’’
উসমানের এক ভাই কলেজের অধ্যাপক। তার এক ছোট বোনও আছে বলে জেরায় স্বীকার করেছে সে। তদন্তে জানা গিয়েছে, দিন দশ-বারো আগে উসমান আর নোমান কুপওয়ারা জেলার টাংমার এলাকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখা পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। তার পর থেকেই বড় মাপের নাশকতার ছক কষছিল তারা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, নোমানও পাকিস্তানের ভাওয়ালপুরের বাসিন্দা। দু’জনেই লস্কর-ই-তইবার সদস্য। এর আগেও তারা কুপওয়ারায় ঢুকেছিল। কিন্তু সে বার বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ফিরে
যায় তারা।
আজ সকালে সেনা পোশাকে সজ্জিত হয়ে উসমানরা যে ভাবে প্রথমে বিএসএফ কনভয়ে হামলা ও পরে গ্রামবাসীদের পণবন্দি করার চেষ্টা করেছে, তাতে পঞ্জাবের গুরদাসপুর হামলার ছায়াই দেখতে পাচ্ছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘গুরুদাসপুরের ঘটনায় হত জঙ্গিরাও লস্করের সদস্য ছিল। সে দিনের মতো আজও প্রথমে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। তার পরে গ্রামবাসীদের পণবন্দি করে নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নামার চেষ্টা করে।’’ গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, আজ জঙ্গিদের মূল লক্ষ্য ছিল অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের কনভয়ে হামলা চালানো। কিন্তু সময়ের হেরফেরে তীর্থযাত্রীদের পরিবর্তে পিছনে থাকা বিএসএফের কনভয়ে হামলা করে বসে তারা।
গুরদাসপুরের হামলার সময়ে নিরাপত্তাবাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল যাতে অন্তত এক জন জঙ্গিকে ধরা যায়। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। দু’পক্ষের সংঘর্ষে মারা যায় সব জঙ্গিই। কিন্তু আজ উসমানকে আটক করতে পেরে খুশি দিল্লি। মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, এ অনেকটা কসাবকে ধরার মতোই সাফল্য। কী ভাবে ধরা
গেল উসমানকে?
উসমানের হাতে পণবন্দি দু’জনের বক্তব্য থেকে উঠে|
এসেছে সেই নাটকীয় অভিজ্ঞতার কথা। বিএসএফের হাত থেকে পালানোর সময়ে পাঁচ পণবন্দিকে নিয়ে পাহাড়ি এবং জঙ্গলঘেরা একটি গ্রামে ঢুকে পড়ে উসমান। তাদের মধ্য থেকে রাকেশ কুমার নামে একজন পরে পুলিশকে জানিয়েছেন, ‘‘রাস্তায় গুলিগোলার শব্দ শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। তখনই ওই জঙ্গি এসে আমায় ধরে। আরও কয়েক জনকে তত ক্ষণে আটক করেছিল সে।’’ গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে উসমানের হাত গলে পালিয়ে যায় দেশরাজ, সুভাষ শর্মা এবং জীবন নামে তিন জন। বাকি দু’জন, রাকেশ আর বিক্রমজিৎকে নিয়ে ওখানকার একটি স্কুলে আশ্রয় নেয় জঙ্গি। বিক্রমজিতের বয়ান অনুযায়ী, ‘‘এ কে ৪৭ দেখিয়ে আমাদের ওই স্কুলের ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের কাছে জানতে চাইছিল, এই এলাকা থেকে কী ভাবে পালিয়ে যাওয়া যায়।’’ এই ভাবে পার হয়ে যায় প্রায় চার ঘণ্টা। মাঝপথে বন্দিদের কাছ থেকে খাবারও জোগাড় করে উসমান। ইতিমধ্যে ওই স্কুলের আশপাশ ঘিরে ফেলে পুলিশ। সেটা বুঝতে পেরে কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়ে উসমান। সেই সুযোগটাই কাজে লাগান পণবন্দিরা।
পুলিশ দেখে উসমান গুলি চালানোর চেষ্টা করলেও শেষমেশ রাকেশ-বিক্রমজিৎ কাবু করেন তাকে। বিক্রমজিতের কথায়, ‘‘আমি ওর ঘাড়টা চেপে ধরি। আর রাকেশ ওর রাইফেলটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির সময়েও ও গুলি চালানোর চেষ্টা করছিল। একটুর জন্য বেঁচে যাই আমরা।’’
চলতি মাসেই ভারত-পাকিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্তরের বৈঠক হতে চলেছে দিল্লিতে। তার ঠিক আগে সন্ত্রাস প্রশ্নে পরপর দু’দিনে দু’টি মোক্ষম অস্ত্র পেল ভারত। তারিক খোসা স্বীকারোক্তি আর ধৃত উসমান। কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে এগুলো অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy