সাংবাদিক বৈঠকে পাশাপাশি লালু-নীতীশ। বুধবার পটনায়। ছবি: শ্যামলী দে।
গত কয়েক মাসে পরস্পরকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন তাঁরা। এমনকী, একে অন্যকে পরোক্ষে ‘বিষ’ বা ‘বিষধর সাপ’ বলতেও ছাড়েননি। স্বাভাবিক ভাবে এর পরে আশায় বুক বেঁধেছিল বিজেপি। তারা ধরেই নিয়েছিল, দু’জনের মধ্যে আসন রফা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হবে। কিন্তু নীতীশ কুমার এবং লালু প্রসাদ তাদের সেই ‘আশা’য় জল ঢেলে কাজটা সেরে ফেললেন অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। বুধবার যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে দু’জনে ঘোষণা করলেন, একশো করে আসনে প্রার্থী দেবেন। ৪০টা রইল কংগ্রেসের জন্য। বাকি তিনটে দেওয়া হবে এনসিপি-কে।
নীতীশ-লালুর এই নিঃশব্দ বিপ্লবে রীতিমতো চমকে গিয়েছেন বিহারের রাজনীতিকরা। এ দিন দু’জনের শরীরী ভাষায় স্পষ্ট, এত দিন যে যা-ই বলুন না কেন, জোটের রথ এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁরা কিন্তু আপাতত বদ্ধপরিকর। জোটের প্রচারও তাঁরা শুরু করছেন অনেক ভেবেচিন্তে। ৩০ অগস্ট পটনায় প্রথম সভা হবে লালু-নীতীশদের। কংগ্রেসের তরফে সেখানে সেই সভায় থাকতে পারেন খোদ সনিয়া বা রাহুল গাঁধী। সেই দিনই কিন্তু পটনা থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে ভাগলপুরে দলীয় জনসভায় হাজির থাকবেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী। অর্থাৎ, ৩০শেই ময়দানে প্রথম মহা-টক্কর লাগবে জোট ও বিজেপির। যার মুখবন্ধ এ দিনই করে রাখলেন লালু, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে মোদীকে আক্রমণ করে: ‘‘এই বিহারেই মোদীর পতন শুরু হবে। শেষ হবে অহঙ্কার।’’
প্রশ্ন হচ্ছে, পরস্পরকে ঠারেঠোরে এত কিছু বলার পরেও এত মসৃণ ভাবে জোট করে ফেললেন কী ভাবে লালু-নীতীশ? বিহার রাজনীতির লোকজন বলছেন, এর পিছনে বড় কারণ ভোট-অঙ্কের শমন। গত বার বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে জোট ছিল নীতীশের। ১৪১টি আসনে লড়ে জিতেছিলেন ১১৫টিতে। আরজেডি একক ভাবে ১৬৮টি আসনে লড়ে। জেতে ২২টি আসনে। কোনও জোট ছাড়াই কংগ্রেস ২৪৩টি আসনে লড়ে জিতেছিল মাত্র ৪টি আসনে। গত লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে দেন নীতীশ। ২০১৪ সালের সেই ভোটে জেডিইউ, আরজেডি, কংগ্রেস— সকলেই
একা লড়েছিল। ফল বেরোনোর পরে দেখা গেল, ৪০টির মধ্যে ৩১টিই জিতে নিয়েছে বিজেপি জোট। অথচ ভোট শতাংশের হিসেবে নীতীশের জেডিইউ, লালুর আরজেডি এবং কংগ্রেস এক হলে এগিয়ে থাকত বিজেপির থেকে। তাদের মিলিত ভোট ৪৫ শতাংশ, সেখানে বিজেপি জোটের মোটে ৩৫-৩৬ শতাংশ।
এর পরেই প্রথম জোটের গুরুত্ব বুঝতে পারেন নীতীশ-লালু। তোড়জোড় শুরু হয় দীর্ঘদিনের দুই যুযুধানের মধ্যে সেতুবন্ধনের। সেই কাজটা করে কংগ্রেস। ফল মেলে হাতে হাতে। ২০১৪ সালে বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপিকে ৬-৪ আসনে হারিয়ে দেয় জোটবদ্ধ তিন দল। এর পরেই শুরু হয় এই জোটকে পাকাপোক্ত চেহারা দেওয়ার কাজ। কংগ্রেসের তরফে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়, নীতীশের নেতৃত্বেই লড়বে জোট। পরিস্থিতির বিচারে লালু সে কথা মেনেও নেন। কারণ, আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় এখন ভোটেই দাঁড়াতে পারবেন না লালু। তাই মুখ্যমন্ত্রী পদের ক্ষেত্রে নীতীশের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জায়গাতেই নেই তিনি। আসন ভাগাভাগির সময়েও কংগ্রেসের চাপ কাজ করেছে বলে বিহারের রাজনীতিকদের একাংশের বক্তব্য।
অন্য আর একটি অংশ বলছে, এখন আসন বণ্টন নিয়ে টালবাহানা করলে জনগণের কাছে বিরূপ বার্তা যেতে পারে বলে দু’জনেরই সংশয় ছিল। তার ওপর পরিস্থিতি এক বার যদি জট পাকিয়ে যায় গেলে সুবিধা হবে বিজেপিরই। এটা বুঝতে পেরেই রফাসূত্র বের করতে তৎপর হন দু’দলের নেতৃত্ব। জেডিইউ ও আরজেডি সূত্রে জানা গিয়েছে, সবার অগোচরে লালু-নীতীশ ঠিক করেন, বৃহত্ স্বার্থে সবাইকেই কিছু না কিছু ছাড়তে হবে। তখনই ১০০-১০০-৪০ আসনের রফাসূত্রটি দেন নীতীশ। লালু তা মেনে নেন।
দিল্লি থেকে কংগ্রেস সূত্রে জানা গিয়েছে, কংগ্রেস নেতৃত্ব, বিশেষ করে সনিয়া গাঁধী দু’জনকেই জানিয়ে দেন, বিহারে ৪০ জন প্রার্থী জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হবে। তাই এনসিপি বা সিপিআই চাইলে কিছু আসন তাঁরা নিজেদের ‘কোটা’ থেকে ছেড়ে দেবেন। এমনকী, কংগ্রেসের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, কিছু আসনে জেডিইউ-আরজেডি প্রার্থীদেরও তাঁরা ‘ছেড়ে’ দিতে পারেন। তবে ওই প্রার্থীরা শুধুমাত্র কংগ্রেসের টিকিটে লড়বেন। এর পরে বিজেপি-বিরোধী এই জোটের আসন বণ্টন নিয়ে আর কোনও সঙ্কট তৈরি হয়নি।
এই মহাজোট সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক বিজেপি শিবির। প্রচারে এসে মোদী বারবারই বিহারবাসীকে মনে করাচ্ছেন, তথাকথিত ‘জঙ্গলরাজের’ কথা। স্বাভাবিক ভাবেই তা গায়ে লেগেছে লালু প্রসাদের। আজ নীতীশকে পাশে বসিয়ে লালু স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বলেছেন, ‘‘হ্যাঁ, গরিবের জন্য কাজ করা সরকারকে তো ‘জঙ্গলরাজ’ বলবেনই। ওঁদের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা, গুজরাত দাঙ্গা সংঘটিত কার সরকার তো ‘মঙ্গলরাজ’!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy