বছর খানেকের সামান্য কিছু দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার বিমুদ্রাকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে সারা দেশের মানুষকে চরম বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছিল। এবং এই বিভ্রান্তির প্রধান শিকার ছিল তথাকথিত মধ্যবিত্ত সমাজ। অল্প বয়স্ক থেকে শুরু করে অসংখ্য বয়স্ক মানুষ তাঁদের কষ্টার্জিত রোজগারের টাকা নিয়ে যখন ব্যাঙ্কের দরজার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত হচ্ছেন, তখন সরকার পক্ষ টিটকারি দিয়ে বলছে— এ আর কী দেখছ? এর পর আরও শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কীসের শাস্তি, কেন শাস্তি? কর ফাঁকি দেওয়াটা অবশ্যই অপরাধ। অবশ্যই তার শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া উচিত। সব রকম দুর্নীতি দমনের জন্যই সরকারি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু ১০০ জন মানুষকে চাবুক মেরে যদি কোটাল বলেন যে ওই ১০০ জনের মধ্যে আসলে ৩ জন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হল, তা হলে সেটা কি সুবিচার করা হল? নিশ্চয় না।
খুশিতে উপচে পড়ে সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে দুর্জনদের এ বার ঘুমের ওষুধের আশ্রয় নিতে হবে। কেবল সজ্জনেরা শান্তিতে থাকবেন। সজ্জন কে? নিম্নবিত্ত বা এক কথায় গরিব লোকজন। অর্থাৎ দেশে যদি অধিকাংশ মানুষেরই নিম্নবিত্তের খাতায় নাম লেখানো থাকে, তবে সেটাই হবে শান্তি ও সুদিনের লক্ষণ।
আগামী বাজেট কোন রাস্তায় চলবে তা ভাবতে গিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন এই সমস্ত কথা মনে এল। কিন্তু মনে আসার বিশেষ একটি কারণ আছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই বর্তমান সরকারের শেষ সম্পূর্ণ বাজেট। অতএব সকলেরই মনে আশা যে, এ বাজেট মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতি সদয় হবে, কারণ তারাই তো মুখ্য করদাতা। অবশ্য নোটবন্দির সময় তারাই ছিল সরকারের চোখে প্রধান সন্দেহভাজন শ্রেণির নাগরিক। এই সন্দেহভাজন শ্রেণিকে সরকার কেন শাস্তির বদলে সুবিধা দেবে? সেটা কি দুর্নীতি দূরীকরণের সহায়ক হবে? সবই বোঝা দায়। কিছু কাল আগেও নাভিশ্বাস উঠিয়ে, এ বার বাজেট-রূপী চাঙ্গায়নী সুধা খাইয়ে এদেরকে সুস্থ করে তোলা হবে, যাতে ভবিষ্যতে আরও শাস্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে এরা বর্তমান সরকারকে পুনর্বার শাসকের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে। অন্তত এই কাজটি করার জন্য তারা যেন আগামী নির্বাচনের দিনটি পর্যন্ত জীবিত থাকে। হই হই করে সকলে মিলে যেন ই ভি এম মেশিনের সঠিক বোতামটিতে আঙুলের চাপ দিয়ে আসে।
এটা নতুন কথা নয়। এই সরকার কেন, এর আগের প্রত্যেক সরকারই তো ৫ বছর রাজত্বের শেষ বাজেটটিকে মধু মাখিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এমনই এই দেশের নিয়ম। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। চিন্তা করেও দেখি না এ সবের অর্থনৈতিক তাৎপর্য কী। একটি বিশেষ বছরে সুবিধা পাওয়ার লোভে পরবর্তী বছরগুলো নিয়ে চিন্তাও করি না। অর্থাৎ স্বল্প মেয়াদী সুখভোগের আশায় আমরা দীর্ঘ মেয়াদী স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভুলে থাকি। তাই আপাতত একটাই প্রশ্ন। আয়করে কি নতুন কোনও ছাড় পাওয়া যাবে? হয়ত যাবে। এবং এ কথাও আমরা জানি যে বাজেট পেশ হওয়ার পরের মুহূর্ত থেকেই বিভিন্ন মহলে পক্ষে বিপক্ষে বহুতর মতামত শোনা যাবে। কেউ বলবে যেমনটা আশা করে গিয়েছিল তেমনটা আর হল কই? ব্যবসায়ী মহল থেকে দাবি আসবে কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় নিয়ে। চাকুরিজীবীরা বলবে ৪ লক্ষ অবধি আয় করমুক্ত করা হল না কেন? বাণিজ্য সংস্থারা জি এস টি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) নিয়ে আরও এক দফা আবেদন নিবেদন করবে।
সরকার পক্ষ বলবে বাণিজ্যের সুবিধার নিরিখে ভারতবর্ষের স্থান ১৩০ থেকে ১০০ তে উঠে এসেছে। আরও বলবে যে বিমুদ্রাকরণের প্রাথমিক ধাক্কা পেরিয়ে আমাদের বৃদ্ধির হার ফের গতিবেগ ফিরে পেয়েছে। আমাদের গতিবেগ চিনকে ছুঁয়ে ফেলেছে অথবা ছাড়িয়ে গিয়েছে। কেবল বলবে না যে, বৃদ্ধির হার দিয়ে অর্থনৈতিক বিকাশ মাপা যায় না। বলবে না, কারণ তারা এ ব্যাপারটা আদৌ বোঝে কি না সন্দেহ। ২০১৬ সালে চিনের মাথা পিছু উৎপাদন ছিল ৬৮৯৩ ডলার আর ভারতের ছিল ১৮৬১ ডলার। বৃদ্ধির হার নিয়ে দাপাদাপি করলেই আমরা চিনকে অদূর ভবিষ্যতে ছুঁতে পারব না। বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই এমন নয়। কিন্তু বৃদ্ধি আমাদের জীবনযাত্রার মানের সূচক নয়।
আমরা শুনব শিক্ষা খাতে আরও নতুন বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু সরকার এমন কথা বলবে না যে দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে আগামী ১০ বছরের মধ্যে। অথচ এমন কাজ অসম্ভব নয়। এই কাজ জাপান করে দেখিয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে। ১৯১০ সালে জাপানে যত বই ছাপা হত, আমেরিকাতেও তত বই ছাপা হত না। আর শিক্ষার এই দেশব্যাপী বিস্তারের ফলেই হয়ত বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মারাত্মক ক্ষতিকে কাটিয়ে জাপান আবার কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর একটি বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পেরেছিল। সুদূর প্রাচ্যের অন্যান্য যে সব দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে গিয়েছে তাদের সকলেরই একই কাহিনি। শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগ।
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য আবার ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে বাধ্য। তার সঙ্গে জি এস টি-র আঁকাবাঁকা রূপায়ণ মিলে খুচরো পণ্যের বাজারকে ক্রেতাদের কাছে আরও কত ভয়াবহ করে তুলবে তাও তো কারও জানা নেই। ফলে আমাদের বাজার অর্থনীতি কোন দিকে এগোবে বোঝা দায়। এ ব্যাপারে বাজেট কী বলবে দেখা যাক। রেপো রেট সম্পর্কিত কোনও ইঙ্গিত থাকবে কি?
আর কী থাকবে এই বাজেটে? গোলা বারুদের কথা বাদ পড়বে না নিশ্চয়ই। এ ছাড়া চিরকালের মত কৃষি উন্নয়নের কথা তো গোড়াতেই থাকবে। থাকবে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার কথা। স্বচ্ছ ভারতের কথা আবারও শুনব। পরিকাঠামোর উন্নতি তো নিশ্চয়ই থাকবে। বুলেট ট্রেন থাকবে কি? বলা কঠিন। থাকবে আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কার, বৈদ্যুতিন ব্যাঙ্ক পরিকাঠামোর উন্নতির ব্যাপারেও শোনা যাবে। এফ আর ডি আই (ফিন্যান্সিয়াল রেজোলিউশন অ্যান্ড ডিপোসিট ইনসিওরেন্স) ব্যাপারটা বাজেট এড়িয়ে যাবে বলেই মনে হয়, যদিও বিষাক্ত ৫২ নং ধারার "বেল-ইন" সম্ভাবনার কথা তুলে নিলে মানুষ কিছুটা শান্তি পেতে পারে। কিন্তু তেমন কথা শোনা যাবে বলে মনে হয় না।
অবশ্য একটা ব্যাপার নিশ্চিত। এ দেশে মানুষ যে ভাবেই থাকুক না কেন, পশু পক্ষী জাতীয় অমানুষরা সুখেই জীবন যাপন করবে। এই বার্তা বাজেটে না থাকলেও, বোধহয় দেশে বিদেশে আগেই জানাজানি হয়ে গিয়েছে। হজে যাওয়ার ভরতুকি উঠল কি না সেটাও বোধহয় তারা জানে। তাই হঠাৎ সাহেব সুবোরা রায় দিয়েছে যে আমাদের অর্থনীতি নাকি সদ্য প্রস্ফুটিত একটি পদ্মের মত ক্রমেই বিকশিত হয়ে উঠছে।
ফুলটির রঙ গেরুয়া। আর আসন্ন বাজেট যে তাকে গেরুয়া-তর করে তুলবে এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy