এ যেন সত্যিই আঠারো মাসে বছর। বিরোধী শিবিরের সব থেকে বড় দলের নেত্রী সনিয়া গাঁধীকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাতে আঠারো মাস লেগে গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। তবু যেন মোদী আজ এক অন্য অবতারে! সংসদে সংবিধান নিয়ে বিতর্কে বার্তা দিচ্ছেন সহমতের ভিত্তিতে চলার।
এ যেন সত্যিই আঠারো মাসে বছর। বিরোধী শিবিরের সব থেকে বড় দলের নেত্রী সনিয়া গাঁধীকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাতে আঠারো মাস লেগে গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। তবু যেন মোদী আজ এক অন্য অবতারে! সংসদে সংবিধান নিয়ে বিতর্কে বার্তা দিচ্ছেন সহমতের ভিত্তিতে চলার। পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) বিলের বরফ গলাতে সরাসরি সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহকে ফোন করে চায়ের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। সেই চায়ের আসরের পরে বিরোধীদের সঙ্গে একসুর হয়ে তাঁর অন্যতম সেনাপতি অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানাচ্ছেন, জিএসটি নিয়ে কথা হয়েছে। দু’পক্ষই দু’পক্ষের কথা শুনেছে। এবং আরও আলোচনা হবে।
আলোচনার বন্ধ দরজাটা খোলা বা তার পরে দু’পক্ষ একই সুরে কথা বলা সত্ত্বেও বিরোধী শিবিরে প্রশ্ন, মোদীর এই নয়া অবতার আদৌ কতটা স্থায়ী হবে? মোদী ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস পর থেকেই কংগ্রেস অভিযোগ তুলে আসছে, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন না। আজকের চা-চক্রে ওই অপবাদ ঘোচানোর চেষ্টা শুরু হলেও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, সংসদে বিল পাশ করানোর দায়েই কি এই বদল? ভবিষ্যতেও কি তিনি সহমতের ভিত্তিতে চলবেন? দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী কাঠামোয় আঘাত ও অসহিষ্ণুতা নিয়ে যে সব অভিযোগ উঠছে নানা মহল থেকে, সে দিকেও কি নজর দেবেন? রাশ টানবেন কি বিজেপি-সঙ্ঘের নেতা ও মন্ত্রীদের হিন্দুত্ববাদী মন্তব্যে ও কাজে? মোদীর কথা ও কাজের মধ্যে ফারাকের অভিযোগ আগেও করেছে কংগ্রেস। আজ সন্ধের চা-চক্রের আগেও প্রশ্নটি তুলেছেন কংগ্রেস সহসভাপতি রাহুল গাঁধী। তাঁর কথায়, ‘‘এই বৈঠক ডাকা হয়েছে জনতার চাপে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রীর কাজের শৈলী এমন নয়।’’
এটা ঘটনা লোকসভায় থাকলেও রাজ্যসভায় গরিষ্ঠতা নেই সরকারের। ফলে জিএসটি বা অন্য যে কোনও বিল পাশ করানোর জন্য বিরোধীদের সমর্থন পাওয়াটা জরুরি। বিভিন্ন দলের নেতারাই মনে করছেন, এ দিনের এই চায়ের আমন্ত্রণ সেই দায় থেকেই। আমন্ত্রণ রাখবেন কি না এ নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সঙ্গে পরামর্শ করার পরে, শেষ পর্যন্ত দু’জনেই যান প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। মোদীর সেই ‘চায়ে পে চর্চা’য় ছিলেন অরুণ জেটলি ও বেঙ্কাইয়া নায়ডুও। পরে জেটলি জানান, ‘‘জিএসটি ও অন্যান্য বিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জিএসটি বিল নিয়ে কংগ্রেস তাঁদের তিনটি আপত্তির কথা জানিয়েছে। সরকারের যু্ক্তিগুলিও তুলে ধরা হয়েছে। জেটলির কথায়, ‘‘ওঁরা তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন। আমরাও ওঁদের আপত্তিগুলি খতিয়ে দেখব। এর পরে বিলগুলি নিয়ে বেঙ্কাইয়া নায়ডু বিরোধীদের সঙ্গে ফের আলোচনা করবেন।’’ কংগ্রেসের তরফে আনন্দ শর্মাও রাতে মোটামুটি একই কথা জানান।
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
চাপ বড় বালাই, মোদীর মুখে কংগ্রেস নাম
ভবিষ্যতের কথা আলাদা, তবে এ দিনের মূল সুরটি ছিল সহমতের। সংসদে বি আর অম্বেডকর ও সংবিধান নিয়ে বিতর্কেও মোদী আজ বারবার বিরোধীদের সঙ্গে ঐকমত্য তৈরির বার্তা দিয়েছেন। কবুল করেছেন, নিজেরাও ত্রুটিমুক্ত নন। লোকসভায় গরিষ্ঠতা আছে বলেই যে শাসক দল যা খুশি তা করতে পারে, এমন ধারণাও নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি দেখানোর চেয়ে সহমতের ভিত্তিতে চলাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’’ কংগ্রেসের মন জয় করতে অম্বেডকরের বিতর্কেও বারবার বলেছেন নেহরুর অবদানের কথা। বার্তা দিতে চেয়েছেন, অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশ জুড়ে ঝড়ের মধ্যেও তিনি আসলে সহিষ্ণুতার পথ ধরেই এগোতে চান।
শুধু মোদীর বক্তৃতায় নয়, সংসদে বিতর্কের পর স্পিকারের প্রস্তাবের খসড়া নিয়েও বিরোধীদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এগিয়েছে সরকার। কংগ্রেসের দাবি মেনে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটি ও তৃণমূলের দাবি মেনে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করেছে তারা।
গত আঠারো মাসে এমন মোদীকে দেখেনি রাইসিনার অলিন্দ। সংসদের গত অধিবেশনেও যখন কংগ্রেসের বিরোধিতায় জমি বিল ভেস্তে যাচ্ছে, তখনও সরাসরি সনিয়াকে ফোন করার কথা ভাবেননি মোদী। তাঁর ‘ঔদ্ধত্য’ দেখে সনিয়াও আগ্রহী হননি কথা বলতে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মনমোহনের বাড়ি গিয়ে দেখা করেছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ছেড়ে যাওয়া ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডের বাসভবনেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সনিয়াকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ডাকেননি কখনও। কিন্তু এখন কংগ্রেসই বলছে, ঠেলার নাম বাবাজি।
তাই প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া কতটা ঠিক হবে, তা নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে মতপার্থক্য ছিল। দলের অনেকেই বলেছেন, লোকসভা নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে আসার পর থেকে মোদী ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার দেখিয়ে এসেছেন। এখন বিহার নির্বাচনে ভরাডুবির পর তিনি নমনীয় ভাব দেখাচ্ছেন। এটিও তাঁর আসল চরিত্র নয়। ফলে তাঁদের ফাঁদে পা দেওয়া উচিত নয়। মনমোহনের সঙ্গে এ নিয়ে আলাদা বৈঠক করেন সনিয়া। পরে অবশ্য মনমোহন বলেন, ‘‘কী বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জানি না। গিয়ে দেখব।’’
সনিয়া-মনমোহনকে আমন্ত্রণ জানানোর সময় রাহুলকে ডাকা নিয়েও বিজেপির মধ্যে একটি ভাবনা ছিল। কিন্তু আপত্তি ওঠে, পরিবারতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিয়ে লাভ নেই। বিজেপি মনে করছে, এ নিয়ে রাহুল ক্ষুব্ধ। মোদীর কাজের শৈলী নিয়ে রাহুলের মন্তব্যে তারই প্রকাশ ঘটেছে। জিএসটি বা অন্য বিল পাশের দায়ে সরকারের সুর বদলালেও বিজেপি যে রাজনীতির জমি আদৌ ছাড়ছে না, রাহুলকে না ডাকার মধ্যেই সেটি বেশ স্পষ্ট।
ক’দিন আগেই জিএসটি নিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী জেটলি। সনিয়ার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন প্রণববাবু। কিন্তু সূত্রের খবর, সনিয়া রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন, ওই বিল নিয়ে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু রাহুলের আছে। রাহুলের উপদেষ্টারা এই বিলের তিনটি মৌলিক বিষয় নিয়ে আপত্তি করছেন। রাহুল আজও বলেন, এই তিনটি বিষয় সরকার মেনে নিলে বিলে সমর্থন করতে কোনও আপত্তি নেই। এতে সাধারণ মানুষেরই লাভ হবে। এ দিনের চা-চক্রের পরেও আনন্দ শর্মার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, জিএসটি-কে ১৮%-এর সীমায় বেঁধে রাখার দাবি থেকে কংগ্রেস সরে আসতে রাজি নয়। জেটলিরা তা মেনে নিতে পারেন, আভাস মিলেছে রাতেই।
অবিশ্বাসের এই বাতাবরণেই মোদী আজ যথাসাধ্য চেষ্টা চালান, যাতে তাঁর অভিপ্রায় নিয়ে কোনও সংশয় না থাকে। এর জন্য সংসদে অম্বেডকর বিতর্কের মঞ্চকে কাজে লাগান ঐকমত্য ও সহিষ্ণুতার বার্তা দিতে। তার আগে অবশ্য জেটলিকে দিয়ে কংগ্রেসের অভিযোগের জবাব দেওয়ানো হয়েছে। জেটলি এ দিন সকালের দিকে রাজ্যসভায় বিতর্ক শুরু করে ইন্দিরা গাঁধীর আমলকে হিটলারের জার্মানির সঙ্গে তুলনা করেন। বলেন, ‘‘যাঁরা আজ অসহিষ্ণুতার কথা বলছে, তাঁরাই জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করে এসেছে।’’ একই সঙ্গে তিনি সঙ্ঘ ও বিজেপি যে হিন্দুত্বের কথা বলে, সেটিকেও পরোক্ষে সমর্থন করেন। তাঁর দাবি, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ তুলে বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক বলা হচ্ছে। এটা অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু মোদী নিজের বক্তৃতায় এ সবের ধারেকাছে ঘেঁষেননি। বরং বোঝাতে চেয়েছেন, কত সহনশীল তিনি। সংবিধানের মূল ভাবকে পুঁজি করেই তিনি দেশ চালাচ্ছেন। ভুল-ভ্রান্তি হলেও তিনি সহমতের ভিত্তিতেই চলতে চান। ঐকমত্য তৈরি করা না গেলে একেবারে শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে সংখ্যাধিক্যের শক্তি। কথাটা লোকসভার সাপেক্ষে বললেও তিনি ভালই জানেন, রাজ্যসভার কাঁটা এখনও বিঁধে রয়েছে। লোকসভা ভোটের পর মোদী, অমিত শাহরা ভেবেছিলেন, বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন জিতে রাজ্যসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে। কিন্তু এখন সেই স্বপ্নভঙ্গ হতে শুরু হয়েছে। ফলে এখন বিরোধীদের সঙ্গে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
তবে কংগ্রেস নেতৃত্ব এখনই মজে যেতে চাইছেন না। শেষ পর্যন্ত জিএসটি বিল হয়তো পাশ করিয়ে দেবে কংগ্রেস। কিন্তু হালে ‘নমনীয়’ মোদীকে সংসদে আরও বেগ দিতেই প্রস্তুত হচ্ছে তারা। কংগ্রেস আগামী সপ্তাহেই মোদী সরকারের সেই সব মন্ত্রীদের ইস্তফার দাবি জানাবে, যাঁরা সম্প্রতি বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy