ওড়নায় ঢাকা মুখ। জেরার জন্য খার থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়কে। শুক্রবার রাতে। ছবি: পি টি আই।
মিখাইল ও শিনা বরা তাঁরই সন্তান। তাঁর স্বামীর নাম জনৈক ‘এস’ দাস। ছেলেমেয়ের দেখভালের দায়িত্ব তিনি দিচ্ছেন তাঁর মা দুর্গারানি বরা-কে। দুর্গারানি হলেন উপেন্দ্রকুমার বরার স্ত্রী।
১৯৯৩ সালে তৈরি এক দত্তকপত্রের হলফনামায় কথাগুলো লিখেছিলেন ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।
গত কাল প্রকাশ্যে এসেছিল শিনার জন্মের একটি শংসাপত্র। যেটি তৈরি হয় ২০০২ সালে। যেখানে শিনার বাবা-মা হিসেবে নাম রয়েছে উপেন্দ্র-দুর্গারানির। শিনার ভাই মিখাইলের দাবি, তাঁদের ভাই-বোন বলে পরিচয় দেওয়ার শর্তে ওই ‘জাল’ শংসাপত্র তৈরি করিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। এবং ঘটনাচক্রে তার পরেই গত কাল সন্ধেবেলা উপেন্দ্রকে উদ্দেশ করে উড়ে এসেছিল প্রশ্ন— তিনি শিনার বাবা না দাদু? উপেন্দ্র জানিয়েছিলেন, তিনি দাদু। শিনার বাবার নাম সিদ্ধার্থ দাস। এর পর আজ ওই দত্তকপত্রটি প্রকাশ্যে আসার পর শিনার বাবার পরিচয় নিয়ে জট ‘কিছুটা’ খোলসা হল বলেই মনে করা হচ্ছে। কেন পুরোটা নয়। সেই প্রসঙ্গ পরে। আগে দেখা যাক, ১৯৯৩-এর ওই হলফনামায় কী লিখেছিলেন ইন্দ্রাণী।
লিখেছিলেন, তাঁর বয়স ২০। স্বামী এস দাসের সঙ্গে ১৯৮৯ থেকে তাঁর যোগাযোগ নেই। তাঁরা ‘পরস্পরের সম্মতিতে’ আলাদা থাকেন। তাঁর দুই সন্তান মিখাইল ও শিনার বয়স যথাক্রমে ৩ ও ৪। সন্তানদের ভার আইনত মাকে দিচ্ছেন তিনি (উপেন্দ্রকেও কিন্তু ‘বাবা’ বলে উল্লেখ করেননি ইন্দ্রাণী। এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠদের অনেকে জানিয়েছেন, ইন্দ্রাণী উপেন্দ্রর ঔরসজাত নন)।
সেই হলফনামা। যেখানে দুই সন্তান শিনা ও মিখাইলকে
মা দুর্গারানি বরার কাছে দত্তক দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন ইন্দ্রাণী।
এই হলফনামা সত্যি হলে শিনার জন্মের সময়ে ইন্দ্রাণীর বয়স মাত্র ১৬ বছর! অর্থাৎ সাধারণ হিসেব বলে, তিনি তখন স্কুলছাত্রী। খটকা এখানেই। একে তো ইন্দ্রাণী তাঁর স্বামীর নামের জায়গায় ‘সিদ্ধার্থ’ লেখেননি।
তার উপর কাল ইন্দ্রাণীর কাকা মানিক বরা বলেছিলেন, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে সিদ্ধার্থর আলাপ শিলংয়ে।
শিনা-মিখাইল তাঁদেরই সন্তান। কিন্তু ইন্দ্রাণী তো শিলংয়ে গিয়েছিলেন কলেজে পড়ার সময়ে। তবে কি সিদ্ধার্থর সঙ্গে তাঁর স্কুল জীবন থেকেই আলাপ? নাকি এই ‘এস দাস’ আদৌ সিদ্ধার্থ নন, অন্য কেউ?
উত্তর নেই। নাম না প্রকাশের শর্তে ইন্দ্রাণীর কয়েক জন সহপাঠিনী জানিয়েছেন, নিত্য-নতুন এত জন পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে ইন্দ্রাণীকে দেখা যেত যে, সহজ-সরল কোনও সমীকরণে আসা তাঁদের পক্ষেও দুষ্কর। গুয়াহাটির সেন্ট মেরিজ স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ার সময়েই একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। এই খবরটা জানালেন গুয়াহাটির একটি নামী ইংরেজি গানের ব্যান্ডের এক গায়িকা। সে যাত্রা ইন্দ্রাণীকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন উপেন্দ্র। ক্লাস টেনে পড়ার সময় ফের পালান ইন্দ্রাণী। একের পর এক এই ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের জেরে স্কুল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ইন্দ্রাণী প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতেও একই গল্প। ইন্দ্রাণী তখন পড়ছেন গুয়াহাটির কটন কলেজে। প্রাক্তন সহপাঠীদের একাংশ জানালেন, দু’বছরে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছিল পরপর দু’টি ছেলে। এবং ইন্দ্রাণী নাকি এই সময়েই গুয়াহাটির এক যুবককে কামাখ্যায় গিয়ে বিয়ে করেন। আইনত বিয়ে সম্ভবত সেটি ছিল না (তবে এই তথ্য সঠিক হলে পিটার মুখোপাধ্যায় আদতে ইন্দ্রাণীর তৃতীয় নন, চতুর্থ স্বামী)।
উচ্চ মাধ্যমিকের পর শিলংয়ের লেডি কিনি কলেজ। আশি-নব্বইয়ের দশকের শিলং তখন নাচ-গান-পার্টিতে রঙিন। সেই সময়ের বন্ধুরা জানাচ্ছেন, রীতিমতো শিলং কাঁপিয়েছেন ইন্দ্রাণী। নতুন নতুন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা যেত তাঁকে। এখন এই সময়েই যদি সিদ্ধার্থের সঙ্গে তাঁর আলাপ ও বিয়ে হয়ে থাকে, তা হলে ফিরে আসে পুরনো প্রশ্নটাই— ১৬ বছরের স্কুলছাত্রী ইন্দ্রাণী কার সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন? আবার ইন্দ্রাণীর পরিচিত কেউ কেউ বলেছেন, গুয়াহাটিতে সিদ্ধার্থ-ইন্দ্রাণীকে স্কুটারে ঘুরতে দেখেছেন তাঁরা। সেই সময়ে ইন্দ্রাণীর কোলে একটি শিশুসন্তান থাকত। কিন্তু সিদ্ধার্থের ব্যবসা মার খাওয়ার পর আচমকা এক দিন ইন্দ্রাণী স্বামী-সন্তান ফেলে উধাও হয়ে যান।
শিনার ভাই মিখাইল অবশ্য গত কালই বলেছেন, তাঁর দিদি জন্মের আসল শংসাপত্রে বাবা হিসেবে সিদ্ধার্থ দাসের নাম রয়েছে। ওই শংসাপত্র তিনি পুলিশকে দিয়েছেন। এ-ও জানিয়েছেন, সিদ্ধার্থ গুয়াহাটি ছেড়ে করিমগঞ্জে চলে গিয়েছিলেন। আর তাঁর কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
যদিও মিখাইলের বয়ানেও অসঙ্গতি পেয়েছে পুলিশ। মিখাইল দাবি করেছিলেন, ২০০২-এ ইন্দ্রাণী-পিটারের বিয়ের পর উপেন্দ্র ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁদের মধ্যে ওই ‘ভাইবোন সংক্রান্ত’ চুক্তিটি হয়। তৈরি হয় উপেন্দ্র-দুর্গারানির নাম দিয়ে শিনার জন্মের ‘জাল শংসাপত্র’ (শিনার ম্যাট্রিকের অ্যাডমিট কার্ডেও বাবার নামের জায়গায় উপেন্দ্রর নাম রয়েছে)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ওই শংসাপত্রটি নথিভুক্ত হয়েছিল ২০০২-এর ৩০ এপ্রিল। আর ইন্দ্রাণী ও পিটারের বিয়ে হয়েছিল ওই বছরের নভেম্বরে। অর্থাৎ সেই হিসেবে পিটারকে বিয়ে করার আগেই ‘জাল’ কাগজপত্র তৈরি করিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। এটা মিখাইল বলেননি।
আজ সকালে মিখাইলকে মুম্বই নিয়ে গিয়ে ইন্দ্রাণীর মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করেছে পুলিশ। আদালতে তাঁর জবানবন্দিও নথিভুক্ত করা হয়েছে। মিখাইলের অনুরোধ মেনে দিসপুর পুলিশ জিএনআরসি হাসপাতালে যোগাযোগ করে তাঁর দাদু-দিদিমার জন্য সর্বক্ষণের নার্স রাখার ব্যবস্থা করেছে। যদিও বন্ধু বা প্রতিবেশীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, পয়সা ওড়াবার স্বভাব ও মদের জন্য ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ঝামেলা লেগেই থাকত মিখাইলের।
স্কুলের বন্ধুদের কথায়, শিনা ছাত্রী হিসাবে উজ্জ্বল ও নজরকাড়া হলেও মিখাইল বরাবরই রগচটা স্বভাবের ছিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারটি ঠিকাদারি করে, রিক্সা ভাড়া খাটিয়ে সংসার চালাত। কিন্তু পিটার ও ইন্দ্রাণীর বিয়ের পর থেকে তাদের বাড়ির চেহারা পালটে যায়। মিখাইল কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠেন, শিনার জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে মডেলের মতো। বাড়ি দোতলা হয়। গাড়ি কেনা হয়। মিখাইলকে বেঙ্গালুরুতে পড়তে পাঠিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। সেখানেই নেশার শিকার হন মিখাইল। ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি রিহ্যাব সেন্টারে তাঁর নেশামুক্তির চিকিৎসাও চলেছিল। প্রতিবেশীদের দাবি, চাকরি ছেড়ে ২০১২ সালে দাদু-দিদিমার সঙ্গে থাকা শুরু করার পরেও মিখাইলের মদের নেশা কমেনি। ইন্দ্রাণী তাঁকে গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। প্রায়ই গাড়ি নিয়ে রাত করে বাড়ি ফেরেন তিনি। জোরে হর্ন বাজান। এ নিয়ে পড়শিদের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদও হয়েছে।
এ দিকে পিটারের দাবি, ইন্দ্রাণী তাঁকে বলেছিলেন, মা দুর্গারানির দুই বিয়ে। তিনি প্রথম পক্ষের সন্তান। শিনা ও মিখাইল দ্বিতীয় পক্ষের। পরিবারের ঘনিষ্ঠদের অনেকেও বলেছেন, ইন্দ্রাণী উপেন্দ্রর সন্তান নন। তবে তেজপুর নিবাসী উপেন্দ্রর খুড়তুতো ভাই মানিক বরা সেই কথা মানতে চাননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy