দোরগোড়ায় বিহার ভোট। তার আগে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসিকে ঘিরে দেশপ্রেমের আবেগ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা খুঁজতে চাইছে বিজেপি। তার পাল্টা হিসেবে আজ মালেগাঁও বিস্ফোরণের নজির টেনে আনছে কংগ্রেস। মুম্বই দাঙ্গা সংক্রান্ত শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের রিপোর্টকে হাতিয়ার করতে চাইছেন বামেরা। প্রশ্ন উঠছে, নাশকতার অন্য ঘটনায় দোষীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার এই তৎপরতা থাকে না কেন!
ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির পরেই কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ বলেন, ‘‘দোষীকে ফাঁসিকাঠে চড়াতে সরকার বেনজির ক্ষিপ্রতা দেখাল ঠিকই। কিন্তু মালেগাঁও বা সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণে দায়ীদের সাজা দিতে এই সক্রিয়তা দেখানো হবে কি?’’ ওই দুই বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন আরএসএস কর্মী সাধ্বী প্রজ্ঞা ও প্রাক্তন সেনা অফিসার কর্নেল শ্রীকান্ত পুরোহিত। এঁদের আরএসএস-যোগ নিয়ে বারবারই বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারকে প্যাঁচে ফেলতে চেয়েছেন বিরোধীরা। সম্প্রতি মালেগাঁও মামলার প্রাক্তন সরকারি কৌঁসুলি, রোহিণী সাইলান অভিযোগ করেন, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ওই অভিযুক্তদের প্রতি ‘নরম’ হতে তাঁকে চাপ দেওয়া হয়েছিল। আজ কৌশলে সেই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তুলে দিগ্বিজয় বলেন, ‘‘আশা করি অন্য সন্ত্রাসের ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতপাত বা ধর্ম বিবেচনা করা
হবে না!’’
বামেরা সামনে আনছেন শ্রীকৃষ্ণ কমিশন রিপোর্টের কথা। যে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরে মুম্বইয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ‘প্রতিশোধ’ হিসেবেই ১৯৯৩-এর মুম্বই বিস্ফোরণের ছক কষা হয়। কমিশনের মতে, ‘‘১৯৯২-এর ঘটনাবলির পরে সরকার ও পুলিশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু যুবকদের বিরাট অংশের মধ্যে প্রবল ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছিল পাকিস্তানি মদতপুষ্ট দেশদ্রোহীরা। ওই যুবকদের প্রতিশোধ নিতে উৎসাহিত করা হয়। দাউদ ইব্রাহিমের নির্দেশে ছক কষে তা কার্যকর করা হয়।’’
বামেদের প্রশ্ন, বাবরি মামলা এবং মুম্বই দাঙ্গা মামলায় অভিযুক্তদের তো ফাঁসি হয়নি! তা হলে ইয়াকুবকে ফাঁসি দেওয়া কতটা সঙ্গত হল? সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এ দিন জানিয়েছেন, এমনিতে মৃত্যুদণ্ড নিয়েই দলের মৌলিক আপত্তি রয়েছে। তা বাদে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও দাঙ্গার চক্রীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, মালেগাঁও মামলার গতি এত শ্লথ কেন, গুজরাত দাঙ্গায় অভিযুক্ত বিজেপি নেত্রী মায়া কো়ডনানি কী ভাবে দীর্ঘদিন মন্ত্রী থেকে গেলেন— এই সব প্রশ্নই তুলছেন ইয়েচুরি।
প্রয়াত শিবসেনা প্রধান বালাসাহেব ঠাকরে থেকে দলের একেবারে নিচুতলার কর্মী— মুম্বই দাঙ্গায় এদের দিকেই সরাসরি আঙুল তুলেছিল শ্রীকৃষ্ণ কমিশন। তার রিপোর্টে মজুত রয়েছে ১৫ হাজার পাতার সাক্ষ্যপ্রমাণ। কিন্তু শাস্তি হয়েছিল কেবল প্রাক্তন শিবসেনা সাংসদ মধুকর সরপোতদার ও দুই পার্টিকর্মীর। তার পরেও সঙ্গে সঙ্গেই জামিন পান সরপোতদার। ২০১০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁকে কোনও সাজাই ভোগ করতে হয়নি। মেমন পরিবারও মুম্বই দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কমিশনের রিপোর্টেই আছে, ইয়াকুবের দাদা টাইগারের ‘প্রতিশোধ নিতে চাওয়ার যথেষ্ট কারণ’ ছিল। ১৯৯৩ সালের মধ্যেই চোরাচালানে রীতিমতো নাম করেছিল টাইগার। মাহিম এলাকায় আল-হুসেইনি বিল্ডিংয়ে তখন থাকত মেমন পরিবার। মাহিম চার্চের কাছে ছিল টাইগারের অফিস। দাঙ্গার সময়ে সেই অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। সেই রাগেই মুম্বই বিস্ফোরণের ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় টাইগার। চোরাচালানের সূত্রে দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
আজ ইয়াকুবের ফাঁসিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন বিস্ফোরণে নিহতদের পরিবারের একাংশ। তবে তাঁদের অনেকেই বলেছেন, মূল চক্রী দাউদ যেখানে অধরা, টাইগার যেখানে বেপাত্তা, সেখানে শুধু ইয়াকুবকে ফাঁসি দেওয়াটা যথেষ্ট নয়। আবার দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের সুবিচারের কী হবে?
এই পরিস্থিতিতে ইয়াকুবের ফাঁসিকে সামনে রেখে বিজেপি ফের মেরুকরণের রাজনীতি উস্কে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বাম-কংগ্রেস। বিজেপি-র সেই রাজনীতিকে ভোঁতা করে দিতেই মুখর হয়েছেন দিগ্বিজয় ও সীতারামেরা। আজ টুইটারে ইয়াকুবের ফাঁসিকে ‘রাষ্ট্রীয় হত্যা’ বলে মন্তব্য করেন কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরও।
জবাবে বিজেপি-র এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের কোনও রং বিচার সরকার করছে না।’’ তাঁর দাবি, বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে কমিশন তৈরি হয়েছে। আদালতেও মামলা চলেছে। কিন্তু লালকৃষ্ণ আডবাণীর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ মেলেনি। গুজরাত দাঙ্গার ঘটনায় ইউপিএ সরকার চেষ্টা করেও নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি। মেমনের ফাঁসির সঙ্গে এই বিষয়গুলি জোড়ার চেষ্টা করা একেবারেই ঠিক নয়। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট যে ফাঁসির নির্দেশ অনুমোদন করেছে, তা নিয়ে কংগ্রেস নেতাদের এমন আচরণ উদ্বেগজনক।’’ তবে এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে
টুইটারে সওয়াল করে দলকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। বাবুল টুইটারে জানান, ১৯৯৩ বিস্ফোরণে দোষী শাস্তি পাওয়ায় তিনি খুশি। তবে ব্যক্তিগত ভাবে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। বিজেপি সূত্রে খবর, বিষয়টি নিয়ে বাবুলের ব্যাখ্যা চায় দল। আসানসোলের সাংসদ দলকে জানিয়েছেন, ওটা ব্যক্তিগত মত। গভীর রাত পর্যন্ত চেষ্টা করেও বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy