বেঙ্গালুরুতে এক সভায় মোদী-শাহ। পিছনে আডবাণী । ছবি: পিটিআই।
লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো প্রবীণ নেতা থেকে দলের ছোট-বড় অনেকের মনেই অসন্তোষ। তবু নিজেদের পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত করতে চাইলেন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। বুঝিয়ে দিলেন, আগামী এক-দু’দশক তাঁদের হাতেই থাকছে বিজেপির ক্ষমতার রাশ। তার জন্য অরাজনৈতিক সামাজিক কর্মসূচির নামে দলের সামাজিক ভিতটি আরও বাড়াতে চাইল এই জুটি।
কালই কর্মসমিতির শেষ দিন। কিন্তু লিখিত কর্মসূচির কোথাও লেখা নেই, আডবাণী বক্তৃতা দেবেন। তার পরও আজ দিনভর মোদী ও অমিত শাহের পক্ষ থেকে আডবাণীকে বাড়তি সম্মান দেখানোর চেষ্টা হয়। সকালেই আডবাণীকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন মোদী। প্রদীপ জ্বালানোর সময়ও অমিত শাহ প্রথমে আডবাণীকে অনুরোধ করেন। কিন্তু দলের রীতি অনুযায়ী সভাপতিকেই প্রথম সুযোগটি দেন আডবাণী। কিন্তু তার পরেও তাঁর আচরণের জড়তা বুঝিয়ে দিয়েছে, অসন্তোষ কাটেনি।
কিন্তু হাল ছাড়েননি মোদী ও শাহ। বরং কর্মসমিতির মঞ্চকে তাঁরা বেছে নিলেন নিজেদের আরও সংগঠিত করতে। গত কাল অমিত শাহের ভূয়সী তারিফ করেছিলেন মোদী। আজ অমিত শাহ করলেন মোদী সরকারের তারিফ। একে অপরের পিঠ চাপড়ে মোদী-শাহ জুটি বুঝিয়ে দিল, দিল্লি হারের পর তাঁদের নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়লেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তাঁরাই। সে জন্য আজ সকালেই অমিত শাহ দিল্লি বিধানসভায় পরাজয়ের দায় সরাসরি রাজ্য নেতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বললেন, তাঁদেরই শিক্ষা নিতে হবে এই হার থেকে। ঘোষণা করলেন— হারে হতাশ হন না, জয়েও কোনও অহঙ্কার হয় না তাঁদের।
অথচ এই হারকে সামনে রেখেই মোদী-বিরোধীরা দলের মধ্যে ঘোঁট পাকানোর চেষ্টায় ছিলেন। দলের এক নেতার মতে, আগে আশঙ্কা ছিল আডবাণী বক্তৃতা দিলে তা কোনও না কোনও ভাবে মোদী-শাহের বিরুদ্ধে যেতে পারে। কিন্তু গত দু’দিনে মোদী ও অমিত সুরটা এমন বেঁধে দিয়েছেন, যার পর আডবাণী তাঁদের বিরোধিতাকে সেই স্তরে নিয়ে যেতে পারতেন না। আজ দলের ঐক্যের ছবি দেখাতে সন্ধ্যার জনসভাতেও আডবাণীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও তাঁকে বক্তৃতায় ডাকা হয়নি। সুষমা স্বরাজ, বেঙ্কাইয়া নায়ডু ছাড়া বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীরাও সেখানে ছিলেন। কিন্তু বক্তৃতা দিয়েছেন মাত্র দু’জন— অমিত শাহ আর নরেন্দ্র মোদী।
বক্তৃতায় গত কালের মোদীর সুরে সুর মিলিয়ে দশ কোটি ছুঁই ছুঁই বিজেপির সদস্যদের সামিল করে কী করে নতুন আন্দোলনের ঘরানা তৈরি করা যায়, তার রূপরেখা এঁকে দেন বিজেপি সভাপতি। স্বচ্ছ ভারত অভিযান ও গঙ্গা সাফাইয়ের মতো কর্মসূচির পাশাপাশি আরও দুটি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। দলের কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, স্বাধীনতার এত বছর পরে এখনও যাঁরা হাত দিয়ে মানুষের মল তোলার কাজ করেন, দেশের সেই ২৩ লক্ষ পরিবারের কাছে যেতে। তাঁরা যাতে অন্য পেশায় যেতে পারেন ও সরকারের যাবতীয় সুবিধা পেতে পারেন, সেটা দেখা হবে। আর ‘বেটি-বাঁচাও, বেটি পড়াও’ অভিযানেও ঘরে ঘরে যাবেন কর্মীরা।
বিজেপির তরফে বলা হয়, রাজনীতির বাইরে এগুলি সামাজিক কর্মসূচি। মহাত্মা গাঁধীর মতো সমাজভাবনায় এই কাজ হবে। কিন্তু মোদী ও শাহ বুঝতে পারছেন, শুধু সদস্য সংখ্যা বাড়ালেই হবে না।
দিল্লি হার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে দলের। মোদী-জাদুও ফিকে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দল যদি সমাজের বিভিন্ন অংশকে ছুঁতে পারে, তা হলেই দীর্ঘমেয়াদে বিজেপির ভিত শক্ত হবে। শক্ত হবে মোদী-শাহের রাশও। তাই সামাজিক কর্মসূচির নামে আসলে রাজনীতিরই অঙ্ক গুনছেন মোদী-শাহ।
পঞ্চশীল থেকে পঞ্চামৃত
১৯৫৪ সালে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সমঝোতাকে সামনে রেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ‘পঞ্চশীল’ চুক্তিকে সামনে এনেছিলেন। যা পরবর্তীতে ভারতের বিদেশনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়। ছয় দশকের ব্যবধানে পারস্পরিক সহাবস্থানের সেই নীতিকেই নয়া মোড়ক দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বেঙ্গালুরুতে বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠকে মোদীর উপস্থিতিতেই পাশ হয়েছে ভারতের বিদেশনীতি সম্পর্কিত প্রস্তাব। এখানে বলা হয়েছে, এখন মোদী জমানায় ‘পঞ্চামৃত’-ই বিদেশনীতির মূল কাঠামো। নেহরুর নীতিতে ‘পঞ্চশীল’-এর অর্থ ছিল— ১) দুই দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন ২) আগ্রাসন থেকে বিরত থাকা ৩) অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা ৪) উভয়ের স্বার্থরক্ষার দিকে নজর দেওয়া ৫) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আর ‘পঞ্চামৃত’-র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মোদীর দল বলছে, এই নীতির মূলে রয়েছে অন্য দেশের সঙ্গে ‘সম্মান’, ‘সংবাদ’ (আলোচনার পথ প্রশস্ত করা), ‘সমৃদ্ধি’, ‘সুরক্ষা’ (সার্বিক নিরাপত্তা) এবং ‘সংস্কৃতি ও সভ্যতা’-র বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা। সঙ্ঘ থেকে বিজেপিতে আসা নেতা রামমাধব এটির খসড়া তৈরি করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy