নমো-নমো। সিডনির অ্যালফোনস অ্যারেনায় নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
দুই মহাদেশ। একই উচ্ছ্বাস। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার আর সিডনির অ্যালফোনস অ্যারেনা। দেশের ‘প্রধান সেবক’ নরেন্দ্র মোদী বুঝিয়ে দিলেন, প্রবাসীদের কাছে জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর ধারেকাছে নেই কোনও ভারতীয় নেতা।
বেশি দূরের পথ নয়। তা-ও রাজীব গাঁধীর পরে কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখতে কেটে গিয়েছে ২৮ বছর। সিডনিতে তাই প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। জানিয়েছেন, আর কখনও তাঁদের এত দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
আমেরিকার মতোই মোদীর সফরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ভারতীয়েরাও। সিডনিতে তাঁর অনুষ্ঠানের জন্য মেলবোর্ন থেকে ‘মোদী এক্সপ্রেসের’ সওয়ারিদের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও জড়ো হয়েছিলেন প্রবাসীরা। যেমন, ম্যাডিসন স্কোয়ারে হাজিরা দেওয়ার প্রবল উৎসাহ দেখা গিয়েছিল আমেরিকা প্রবাসীদের মধ্যে। হিসেব বলছে, ম্যাডিসনের তুলনায় সংখ্যাটা একটু কম। নিউ ইয়র্কে ২০ হাজার। সিডনিতে ১৬ হাজার। কিন্তু সিডনি অলিম্পিক পার্কের অ্যালফোনস অ্যারেনায় মোদীর মন্ত্রমুগ্ধ ভক্তদের কাছে এ সবই আজ অবান্তর হয়ে গিয়েছে। আজ সকালে ব্রিসবেন থেকে সিডনি পৌঁছন মোদী। বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের চার জনের এক নাচিয়ে দল। নাচগানের পরে মোদীকে সে দেশের সুপরিচিত অস্ত্র বুমেরাং উপহার দেন তাঁরা। পরে কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ক্যাম্পবেল নিউম্যানের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠকে যোগ দেন মোদী।
অ্যালফোনস অ্যারেনায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে কোনও ত্রুটি রাখেননি আয়োজকরা। দর্শকদের পোশাকের রঙে ভারতের জাতীয় পতাকা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল অ্যারেনায়। আর মঞ্চেও নাচগান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভারতীয়ত্বের ভাবনা উস্কে দেওয়ার কাজ চলছিল।
অপেক্ষার শেষে যখন মঞ্চে উঠলেন ‘নরেন্দ্র মোদীজি’, তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার ব্রেট লি। বরাবরই ভারত আর ভারতীয় ছবি-গানের ভক্ত ব্রেট। প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে তৈরি একটি ছবিতে তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করছেন। আজ ভারতের কর্ণধারকে অভ্যর্থনা জানাতে মঞ্চে নায়িকা তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়েই উপস্থিত ছিলেন ব্রেট। সকলকে জানিয়েছেন ‘নমস্কার’।
অভ্যর্থনার এই জোয়ারে হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর পিছনে যে প্রবল প্রত্যাশা রয়েছে, এবং তা নিয়ে যে তিনি পুরোপুরি সচেতন, সেটা বক্তৃতায় বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন মোদী। বলেছেন অনেকে বড় বড় কাজ করার স্বপ্ন দেখেন। তিনি ছোট ছোট কাজ করতে চান। ছোট ছোট মানুষের পাশে থেকে তাঁদের অনেক বড় করতে চান। হাততালিতে ফেটে পড়েছে অ্যালফোনস অ্যারেনা। অনেক দিন ধরে অনেকেই আলোচনা করেছেন। আজ এক জন মোদীকে জোর গলায় জানিয়েই দিলেন, তিনি ‘রকস্টার’। ছোট কাজগুলো কী রকম? মোদী জানাচ্ছেন, যেমন শৌচাগার তৈরি। গ্রামে মা-বোনেরা সম্ভ্রম বাঁচিয়ে শৌচাগারে যেতে পারেন না ভেবে তাঁর লজ্জা করে। তাই ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান। অনাবাসীরা তাঁদের শিকড়ে এই প্রকল্পে যোগ দিতে পারেন। তিনি তাঁদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
আবার যেমন সকলের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। ছোট কাজ করতে খুব বেশি সময় দিতে যে তিনি রাজি নন তা সাফ জানিয়েছেন মোদী। তাই এই পরিকল্পনার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ৩ বছর, অর্থ মন্ত্রক ২ বছর আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর ১ বছর সময় চাইলেও তিনি ঘাবড়াননি। বলে দিয়েছেন ১৫০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।
তারুণ্যকে যে তাঁর বড় পছন্দ তা কখনও গোপন করেন না মোদী। ভারতের জনসংখ্যার এক বড় অংশই যে তরুণ-তরুণী। আজও তিনি তাঁদের বোঝাতে চেয়েছেন, অপেক্ষা করে কোনও লাভ নেই। কাজে নামতে হবে। মোদীর কথায়, “স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেকেই ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁরা যদি ভাবতেন তাঁদের জীবনকালে স্বাধীনতা না এলে তাঁরা লড়বেন না, তা হলে কি হত? কখনওই ভারত স্বাধীন হতো না?” মোদীর আক্ষেপ, “আমরা দেশের জন্য মরার সুযোগ পাইনি। তবে দেশের জন্য লড়াই এখনও করতে পারি।” অস্ট্রেলিয়ার লগ্নি চাই মোদীর। তাই জানিয়ে দিয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় আইন তুলে দিচ্ছেন তিনি। আগের সরকারকে কটাক্ষ করে তাঁর মন্তব্য, “জানলা দিয়ে কিছুটা খোলা বাতাস আসা দরকার।” আমেরিকাতেই জানান, ভারতীয় বংশোদ্ভূত (পার্সন অব ইন্ডিয়ান অরিজিন) ও বিদেশে থাকা ভারতীয় নাগরিক (ওভারসিজ সিটিজেন অব ইন্ডিয়া)-র পার্থক্য ঘুচিয়ে দেওয়া হবে। আজ জানালেন, ৭ জানুয়ারি আমদাবাদে প্রবাসী ভারতীয় দিবসের আগেই ওই পার্থক্য ঘোচানোর কাজ শেষ হবে। অস্ট্রেলীয় পর্যটকদের জন্য ‘এলেই ভিসা (ভিসা অন অ্যারাইভাল)’-র ব্যবস্থাও করছে সরকার। মোদী এও মনে করাচ্ছেন, ভারত যত পরিচ্ছন্ন (হিন্দিতে স্বচ্ছ) হবে, ততই বাড়বে পর্যটকরা। বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, প্রবাসীদের ভারতের কাজে লাগানোর এই পরিকল্পনা সফল করতে কাজ করছে মোদীর একাধিক টিম। তাদের মধ্যে বিজেপির প্রবাসী ভারতীয় শাখা ছাড়াও রয়েছে মোদীর ব্যক্তিগত উপদেষ্টার দল। মোদীর সফরের তিন মাস আগে গিয়ে জমি তৈরি করেন বিজেপি নেতা বিজয় জলি ও তাঁর সহযোগীরা। প্রবাসীদের মন জয় করলে যে দেশে তাঁদের শিকড়েও তিনি জনপ্রিয় হতে পারেন তা জানেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেস কটাক্ষ করে ভারত থেকে লোক নিয়ে গিয়েছে বিজেপি। আজ অরুণ জেটলির পাল্টা কটাক্ষ, “কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের সভায় ভারতে যা ভিড় হয় সিডনিতে মোদীর সভায় তার বেশি ভিড় হয়েছে।”
লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে মালিকের কাছে ফিরে আসে বুমেরাং। প্রত্যাশা মেটাতে না পারলে বিপদে পড়তে হয় নেতাদের। মোদীর ক্ষেত্রে কী হবে তার জবাব দেবে সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy