এক যুগ পরে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। ১৩ নভেম্বর, ২০১৫। ছবি: এএফপি।
ন রেন্দ্র মোদী যে ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দেন না, তা দেখে ভাল লাগল। আজ অবধি কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যা করেননি, মোদী করলেন— লন্ডনে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি হিন্দিতে কথা বললেন। নেতা বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অটলবিহারী বাজপেয়ী অন্য সব দিক থেকেই মোদীর চেয়ে অনেক বড় মাপের ছিলেন, কিন্তু এই একটা জায়গায় এসে তিনি আশ্চর্য রকম ঠেকে যেতেন। ইংরেজিতে কথা বলতে গেলেই তাঁর সুপরিচিত বাগ্মিতা কোথায় উধাও হয়ে যেত। টোনি ব্লেয়ার মনমোহন সিংহকে একটা গল্প বলেছিলেন। ২০০২ সালে ব্লেয়ার একাধিক বার দিল্লি সফরে আসেন। তেমনই এক সফরের আগে জর্জ বুশ তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিছু দিন আগেই দিল্লি থেকে ঘুরে আসার পর ফের যাওয়ার দরকার হচ্ছে কেন? ব্লেয়ার সহাস্য উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আগের সফরে বাজপেয়ীকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। আশা করছি, এই দফায় তার উত্তর পাব!’
মোদী কোনও প্রশ্নের দিতে এর কণামাত্র সময় নেননি। এবং, যেহেতু তিনি হিন্দিতে উত্তর দিয়েছেন, উত্তরগুলোও একেবারে চোস্ত ছিল। এক সাংবাদিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদী যা করেছিলেন, তার জন্য তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম দুই বছর তাঁকে ব্রিটেনে আসতে দেওয়া হয়নি। তেমন এক জনকে স্বাগত জানাতে অস্বস্তি হচ্ছে না তো? প্রশ্নের উত্তরটি মোদী দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সত্যের খাতিরে যা জানানো দরকার’, সেটা তাঁকে বলতেই হবে— ‘কিপ দ্য রেকর্ড স্ট্রেট’। ব্রিটেনে আসতে তাঁর কখনও বাধা ছিল না। ২০০৩ সালে তিনি যখন এসেছিলেন, তখন সাদর অভ্যর্থনাই পেয়েছিলেন। তার পর আর এসে ওঠা হয়নি, এই যা।
২০০৩ সালের সত্য
প্রকৃত ঘটনা ছিল ঈষৎ জটিলতর। ২০০২-এ গুজরাত দাঙ্গার পর ব্রিটেনের মি়ডিয়া ক্ষেপে উঠেছিল। কনজার্ভেটিভরা দাবি তুলেছিলেন, লেবার সরকার প্রমাণ করুক যে তাদের বিদেশ নীতি সত্যিই নৈতিকতার ভিত্তিতে চলে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলি প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিল। অনাবাসী ভারতীয়রাও গুজরাত-প্রশ্নে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছেছিল। পরিস্থিতি সামলাতে ব্রিটেনের বিদেশ দফতরের ইন্ডিয়া ডেস্ক আর ভারতীয় হাই কমিশনের কালঘাম ছুটেছিল। অগস্ট মাসে আডবাণী ব্রিটেন সফরে এসে বললেন, যে ঘটনাকে সমর্থন করা যায় না, তাকে তিনি সমর্থনের চেষ্টাও করবেন না। আডবাণীর কথায় খানিক কাজ হয়েছিল, সন্দেহ নেই, কিন্তু গুজরাত দাঙ্গার ভয়াবহতা এবং সেই প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এমনই তীব্র ছিল যে সেই স্মৃতি শুকনো কথায় মোছা কার্যত অসম্ভব।
এরই মধ্যে মোদী জানালেন, তিনি অনাবাসী হিন্দু ভারতীয়দের আমন্ত্রণে ২০০৩-এর গ্রীষ্মে ব্রিটেনে আসছেন। এই সংবাদে ব্রিটেনের সরকারের যে প্রতিক্রিয়া ছিল, তাকে উষ্ণ বা সম্মানজনক বললে সত্যের অপলাপ হবে। ব্রিটেনের সরকার বিবিধ কারণে ভয়ানক আতান্তরে পড়েছিল। তখন এক দিকে ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান আর অন্য দিকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র অনিবার্য ফল হিসাবে ক্রমবর্ধমান ইসলাম-ভীতির দ্বিমুখী চাপে ব্রিটেনের মুসলিম জনগোষ্ঠী যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। সেই সময় মোদীর মতো এক জন নেতাকে ব্রিটেনে স্বাগত জানানো সে দেশের সরকারের পক্ষে স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন ছিল। মোদী সফরে এলে ব্রিটেন সরকারকে বাধ্য হয়েই তাঁর সম্বন্ধে কড়া কথা বলতে হত। অন্যান্য নেতাদের প্রতি যে সৌজন্য দেখানো হয়, মোদীর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম করতে হত। আবার, মোদীর সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার তেমন সৌজন্যহীন আচরণ করলে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর তার প্রভাব পড়ত। এ দিকে সে সময় ‘ভারত উদয়’ হচ্ছে। ফলে, ব্রিটেনের কাছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের দামও বাড়ছে।
তখন আমি ব্রিটেনে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার। ব্রিটিশ বিদেশ মন্ত্রক থেকে ভারতীয় হাইকমিশনে জরুরি বার্তা এল: ব্রিটিশ সরকারের এই অস্বস্তির কথা যেন অবিলম্বে দিল্লিতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এবং, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে মোদী যেন তাঁর ব্রিটেন সফরের আমন্ত্রণটি গ্রহণ না করেন।
হাইকমিশনের কাছেও ছবিটা পরিষ্কার ছিল। গুজরাত দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে যে ঝড় বয়েছিল, আমরা তার ধাক্কার জোর জানতাম। জানা ছিল যে মোদী ব্রিটেনে এলে অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ বাড়বে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর কুপ্রভাব পড়বে। ফলে, দিল্লিতে বিদেশ দফতরে কড়া বার্তা পাঠানো হল: মোদীকে আসতে বারণ করা হোক। খবর পেলাম, বিদেশ মন্ত্রকও সহমত ছিল। কিন্তু, মোদী কোনও পরামর্শেই কান দিলেন না।
বাজপেয়ীর কথাও খাটল না
এর পর এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। হাই কমিশনকে জানানো হল, সফরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বিদেশমন্ত্রী সোজা প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর কাছে গিয়েছিলেন; প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, এ সফর বাতিল করা উচিত; কিন্তু তা সত্ত্বেও সফরটি হতে চলেছে। বোঝা গেল, প্রভাবশালী মহল থেকে বলা হয়েছে, মোদী যখন আমন্ত্রণ পেয়েছেন তখন তাঁকে আমন্ত্রণ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হোক, না হলে ব্রিটেনের চাপের কাছে নতিস্বীকার করা হবে, সেটা দুর্বলতা ও অপরাধবোধের পরিচায়ক। বোঝা গেল, যাঁরা এই উপদেশ দিয়েছেন, তাঁদের কথা অমান্য করা চলবে না, প্রধানমন্ত্রীর আপত্তি থাকলেও।
দু’দেশের সরকারের ষোলো আনা আপত্তি সত্ত্বেও এই সফর অনুষ্ঠিত হল। এক দিকে মোদী ব্রিটেনে গুজরাতি হিন্দুদের সভায় বিপুল অভিনন্দন পেলেন, অন্য দিকে মুসলমান এবং মানবাধিকার কর্মীরা প্রতিবাদে মুখর হলেন। ব্রিটিশ সরকার সফরকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল না, তবে তীক্ষ্ণ নজর রাখল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এক বিবৃতি দিয়েছিল। তাতে কোনও উষ্ণতা ছিল না, কোনও সম্মানও নয়। তারা বলে, ‘আমরা জানি, তিনি ব্রিটেনে সফর করছেন। তিনি মহামান্য রানির সরকারের আমন্ত্রণে আসেননি, তিনি যখন এখানে থাকবেন তখন তাঁর সঙ্গে কোনও ধরনের যোগাযোগের পরিকল্পনাও সরকারের নেই। (এই সফরের বিরুদ্ধে) যে সব আপত্তি উঠেছে, আমরা সেগুলি নিশ্চয়ই বুঝি, কিন্তু শ্রীযুক্ত মোদীকে ভিসা না দেওয়ার উপযুক্ত কোনও কারণ ছিল না।’
গ্রেফতারির ভয়
নরেন্দ্র মোদীর সফরের দ্বিতীয় দিনে ব্রিটেনের বিদেশ দফতর থেকে হাই কমিশনের কাছে এক আতঙ্কিত বার্তা এসেছিল। ব্রিটিশ আইনে ‘নাগরিকের গ্রেফতারি’র (সিটিজেন’স অ্যারেস্ট) একটি বিধান আছে: নাগরিকরা কাউকে অপরাধে জড়িত বলে মনে করলে তাঁরা তাঁকে আটক করতে পারেন। জিম্বাবোয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের ক্ষেত্রে সেই আইন প্রয়োগের উদ্যোগ হয়েছিল। বিদেশ মন্ত্রকের কাছে খবর আছে, মোদীর ক্ষেত্রেও তেমন উদ্যোগ হতে পারে। অন্য দিকে, কিছু আইনজীবী নাকি প্রচলিত পথে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করানোর চেষ্টাও চালাচ্ছেন। যে কোনও একটি উদ্যোগ সফল হলেই একটা কেলেঙ্কারি হবে। হয় ব্রিটিশ সরকারকে নিজের দেশের আইন অমান্য করে মোদীকে সে দেশ ছাড়ার অনুমতি দিতে হবে, অন্যথা, ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লন্ডনে গ্রেফতার হলে দু’দেশের সম্পর্কে একটা বিরাট ধাক্কা লাগবে। ব্রিটিশ বিদেশ মন্ত্রক হাই কমিশন মারফত অনুরোধ জানাল, গ্রেফতারি এড়াতে মোদী যেন পরের বিমানটিতেই সে দেশ থেকে বিদায় নেন। খবরটা দিল্লিতে পৌঁছলে সেখানকার কর্তারাও আতঙ্কিত হলেন। হাই কমিশনকে বলা হল, সর্বোচ্চ মহল থেকে যেন প্রয়োজনীয় নির্দেশটি যথাস্থানে জানানো হয়। তারা সেটা জানালও, কিন্তু উত্তর মিলল যে, মুখ্যমন্ত্রী সে কথা শুনতে নারাজ। তিনি বলেছেন, গ্রেফতার করা হলে স্বদেশে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, বিরাট রাজনৈতিক সুবিধে পাবেন তিনি। পরিষ্কার বোঝা গেল, তাঁর কাছে ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাই সবচেয়ে মূল্যবান। ভারত ও ব্রিটেনের যে সুসম্পর্ক এত যত্নে নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে, তারও কোনও গুরুত্ব নেই।
গ্রেফতারির আবেদন আদালতে নাকচ হল। ‘নাগরিকের গ্রেফতারি’ আটকাতে ব্রিটিশরা মোদীর চার পাশে একটা অদৃশ্য বেষ্টনী তৈরি করলেন। আরও ক’দিন তিনি লন্ডনের মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ালেন, তার পর নির্ধারিত সময়সূচি মেনে ব্রিটেন ছাড়লেন। দু’দেশেই পরম স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল।
২০০৫: বীরত্বের চেয়ে সতর্কতা ভাল
এর একটা অদ্ভুত উত্তরকাণ্ড আছে। কয়েক মাস পরে এক সংসদীয় আন্ডারসেক্রেটারি হাই কমিশনকে জানালেন, তিনি ভারতে যাচ্ছেন এবং দিল্লিতে নির্ধারিত বৈঠকগুলি সেরে গুজরাতে অক্ষরধাম মন্দির দর্শনে যাবেন, কারণ ব্রিটেনে তাঁর সংসদীয় এলাকায় অনেক গুজরাতি মানুষের বাস। তিনি হাই কমিশনারের কাছে জানতে চাইলেন, চুপচাপ মুখ্যমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তাঁর একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে পারেন কি না। (ইত্যবসরে ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রণায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন মোদীকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।) তিনি পরিষ্কার জানালেন, মোদীর কাছে মার্জনা না পেলে তিনি তাঁর এলাকার গুজরাতি ভোটদাতাদের ভোট হারাবেন। আরও তিন জন ছোটখাটো মন্ত্রী এর পরে একই ধরনের যাত্রা করলেন। সন্দেহ জাগল, ব্রিটেনে গুজরাতি বংশোদ্ভূত মানুষদের কেউ বুঝিয়েছেন, তাঁদের ভোট পেতে চাইলে ব্রিটিশ জনপ্রতিনিধিদের অনুতাপ এবং প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত।
নাটক চরমে উঠল ২০০৫ সালের মার্চ মাসে, যখন মুখ্যমন্ত্রী আবার নানা হিন্দু গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে ব্রিটেন সফরের পরিকল্পনা করলেন। এ বার ব্রিটিশ সরকার আরও প্রবল আপত্তি জানাল। এর একটা বড় কারণ, তাদের ভয় ছিল, ২০০৩ সালে মোদীকে গ্রেফতার করার যে আবেদনটি খুঁটিনাটিগত কারণে নাকচ হয়েছিল, এ বার আদালত তা মেনে নিতে পারে, এবং তা হলে একটা ভয়ানক কূটনৈতিক সংকট উপস্থিত হবে। তখন দিল্লিতে ইউপিএ সরকার। তারা মোদীকে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, তিনি বারণ না শুনে যেতে চাইলে যান, কিন্তু নিজের দায়িত্বে যেতে হবে। মোদী বিবেচনার পরিচয় দিলেন, সফর বাতিল করলেন।
ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফর অনেক ইতিহাস তৈরি করেছে। সে সবই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু, তাঁর কথাতেই বলা যায়, ‘সত্যের খাতিরে’ অতীত সম্পর্কে ঠিক ঠিক ইতিহাস নথিভুক্ত করা দরকার।
ভূতপূর্ব কূটনীতিক। তিনি পাকিস্তানে ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেরও সদস্য ছিলেন।
সৌজন্য: http://thewire.in/-এ ১৭ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে When Mr. Modi Went to London শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত।
The Wire-এর সৌজন্যে লেখাটি অনূদিত হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy