ক্যানসার কি যত না বেশি রোগ, তার চেয়ে বেশি বাণিজ্য? আতঙ্কের বাণিজ্য? তা না হলে পরিবারের কারও ক্যানসার হয়েছে জানার পরে কেন প্রথমেই মনে আসে, ‘‘তবে কি এ বার ধনেপ্রাণে শেষ হতে হবে?’’ সাধারণ রোগী, রোগীর স্বার্থে কাজ করা সংগঠন, চিকিৎসকদের একাংশ তো এ নিয়ে বলছিলেনই। এ বার একই কথা শোনা গেল নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মুখেও।
তাঁর মতে, যত দিন না গরিব রোগীদের ঠকানো বন্ধ হবে তত দিন সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা— স্লোগান শুধু মুখের কথা হয়েই থাকবে।
এক দিকে, মুম্বইয়ের টাটা ক্যানসার হাসপাতালের প্লাটিনাম জয়ন্তী উপলক্ষে সম্মেলনে যখন এ নিয়ে চর্চা চলছে। তখনই মুম্বই এয়ারপোর্ট থেকে প্রৌঢ়া মাকে নিয়ে মুম্বইয়ের ক্যানসার হাসপাতালের দিকে রওনা হয়েছেন কলকাতার বেহালার বাসিন্দা বছর পঁচিশের স্নিগ্ধা বসাক। বেসরকারি সংস্থার স্বল্প বেতনের চাকরি করা স্নিগ্ধার মা ছাড়া আর কেউ নেই।
মায়ের ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ার পরে যা সঞ্চয় ছিল তার অধিকাংশই বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। জলের মতো টাকা খরচ করে এ বার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মুম্বই এসেছেন তিনি। শেষ চেষ্টা করতে। টাকার সংস্থান যদি না-ই থাকে, তা হলে কেন সরকারি হাসপাতালে গেলেন না? সেখানে তো এখন সবই ফ্রি! স্নিগ্ধা জানান, গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে লম্বা লাইন। রেডিয়েশনের তারিখ পেয়েছিলেন চার মাস পর। ‘‘তত দিন কি মা বাঁচবে?’’
তাই বেসরকারি হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘোরা। মায়ের অসুখের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কিছুই জানতে পারছেন না। অথচ ডাক্তারের ফি, হাসপাতালের বিল বাড়ছে লাফিয়ে। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাই ভিন্ রাজ্যে এসেছেন তাঁরা।
স্নিগ্ধা অবশ্য জানেন না, তিনি যে সময়ে মুম্বইয়ের টাটা ক্যানসার হাসপাতালে ঢুকছেন, সেই সময়েই টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এর প্রেক্ষাগৃহে অমর্ত্য সেন বলছেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশের গরিব রোগীদের ঠকানোর প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। শুধু ক্যানসার নয়, সব রোগের ক্ষেত্রেই।’’ তিনি জানান, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার সুযোগ নিয়ে বহু বেসরকারি চিকিৎসক রোগীদের অকারণ অস্ত্রোপচার করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রয়োজন ছাড়াই তরুণীর হিস্টেরেক্টমি করে দেওয়া হচ্ছে। কারণ যত বেশি ‘কেস’ তত বেশি টাকা। এই ব্যাপারে বহু তথ্য প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।’’
অমর্ত্য সেনের কথায়, রোগী ঠকানো বন্ধ করার দায়িত্বটা কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে। না-হলে এ কাজ বন্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘‘সমাজে বেসরকারি হাসপাতালের নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা সমাধান সূত্র হতে পারে না।’’
ক্যানসারের চিকিৎসাতেও যে রোগী ঠকানোর প্রবণতা চলছে তা মেনে নেন এই সম্মেলনে যোগ দিতে আসা দেশ বিদেশের ক্যানসার চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের মতে, এই প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
এ ব্যাপারে নীতি আয়োগের কী ভূমিকা? অনুষ্ঠানে হাজির নীতি আয়োগের উপদেষ্টা অলোক কুমার বলেন, ‘‘আমরা ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’। প্রয়োগের বিষয়টা সরকারকে, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলগুলিকে ঠিক করতে হবে। চিকিৎসার নামে যাঁরা লোক ঠকান, তাঁদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা জরুরি।’’
প্রশ্ন উঠেছে, লোক ঠকানো হয় কী ভাবে? সম্মেলনে উপস্থিত চিকিৎসকেরা স্বীকার করেছেন, রোগের মাত্রা বুঝেও পরিবারের লোককে তা না জানানো, কম দামের অথচ কার্যকরী ওষুধ থাকা সত্ত্বেও গরিব মানুষকে শোষণ করে বেশি দামের ওষুধ কিনতে বাধ্য করা, যে মানুষটির আয়ু বড় জোর দু’মাস, তাঁকে কার্যত জোর করে কয়েক লক্ষ টাকার অস্ত্রোপচার করে পরিবারকে সর্বস্বান্ত করা ইত্যাদি। পিজিআই চণ্ডীগড়ের চিকিৎসক শঙ্কর প্রিনজাও খরচ বাড়িয়ে তোলার এই প্রবণতাকে ‘বিধ্বংসী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
মুম্বইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর সুদীপ গুপ্ত বলেন, ‘‘কোনও একটা দূরত্ব আপনি ট্যাক্সিতে যাবেন না মার্সিডিজে যাবেন, তার ওপর খরচ নির্ভর করে। বেসিক কেমোথেরাপি, অপারেশন, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি, এগুলির খরচ মোটামুটি এক। এগুলিতেই ক্যানসারের ৯০ শতাংশ চিকিৎসা হয়ে যায়। অথচ এগুলি থেকেই অনৈতিক ভাবে বেশি টাকা আদায় করছে বহু হাসপাতাল।’’
তাঁর বক্তব্য, অকারণে দামি ওষুধ, ইঞ্জেকশন প্রেসক্রাইব করা হয়। রোগীর পরিবারের চোখে মায়া কাজল পরিয়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়, দামি ওষুধে রোগ সারবেই।
তার ফলাফল? তিনি বলেন, ‘‘বেশি দামি ওষুধের সঙ্গে বেশি আয়ুর যোগাযোগটা ক্ষীণ। অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ওই সব ওষুধে আয়ু দু’ চার মাসের বেশি বাড়ে না। এই জায়গাতেই আমরা অন্যদের থেকে পার্থক্য রাখার চেষ্টা করি। আরও অনেক প্রতিষ্ঠানও ইদানিং এটা শুরু করেছে| কিন্তু এখনও অনেক পথ বাকি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy