বাড়িতেই শুশ্রূষা বাবলি দাসের। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র
সকাল থেকে দরজা-জানলা বন্ধ। দু’কামরার বাড়ির একটা ঘরে ছেলেকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্য ঘরে তিনি একা। এ দিকে, কলিং বেল বেজে চলেছে ক্রমাগত। সঙ্গে কড়া নাড়া। দুর্গানগর স্টেশন থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে এক তস্য গলির ঘুপচি দোতলা বাড়ির একতলায় আক্ষরিক অর্থেই মুখ লুকিয়ে রয়েছেন সিদ্ধার্থ দাসের স্ত্রী বাবলি।
ক্লান্ত বাবলিকে এক-আধ ঝলক দেখা যাচ্ছিল কৌতূহলীদের ভিড় ঠেকাতে। ওড়নায় মুখ ঢাকা। খুব চেনা দু’এক জন ছাড়া ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না কারও। দুপুরে দমদম পুরসভার কাউন্সিলর রিঙ্কু দত্ত হন্তদন্ত হয়ে এক ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। জানা গেল, মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বাবলি। কিছু ক্ষণ পর নকুলচন্দ্র বিশ্বাস নামে ওই ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে জানালেন, বাবলির রক্তচাপ বেড়ে ২১০/১৩০ হয়েছে। রক্তচাপ কমানোর ইঞ্জেকশন দিতে হয়েছে। বিছানা থেকে ওঠার মতো অবস্থা নেই তাঁর। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। কিন্তু সে কথা শোনেননি বাবলি। জানিয়েছেন, আপাতত এই বাড়ি ছেড়ে নড়বেন না তিনি। এই বাড়িতে দাস পরিবার ভাড়ায় এসেছে বছর দেড়েক হল। তার আগে পাশে একটা এক কামরার ফ্ল্যাটে থাকতেন তাঁরা। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে এই পরিবারের বেশ সদ্ভাব, জানালেন বাড়িওয়ালা শ্রীদাম মণ্ডল। সহমর্মিতার সুরে বলেন, ‘‘দেখুন, ২৫ বছর আগে কী হয়েছে, তা নিয়ে এখন ওঁদের জেরবার করা ঠিক নয়। ওঁদের তো কোনও দোষ নেই!’’
বস্তুত এই মনোভাব গোটা পাড়ারই। সিদ্ধার্থ, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেকে আগলে রাখার চেষ্টা করছেন সকলেই। দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ওই ছেলে এ দিন স্কুলে যায়নি। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন সকালেই। তার পর থেকে একটা ঘরে তাকে আটকে রেখে পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন মা বাবলিই। বাড়িতে ভিড় করে আসা সাংবাদিকদের বারবার বলেছেন, ‘‘আমি এ সবের বিন্দুবিসর্গ জানতাম না। এখন জেনেছি। ব্যস্, এর বেশি আর কিছু নয়।’’ বারবারই চেয়েছেন, তাঁর ছবি যেন তোলা না হয়। বলেছেন, ‘‘আমার ছবি তুললে কি খুনি ধরা পড়বে? তা হলে আমি নিজেই এগিয়ে যাব। নইলে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’’ কিন্তু জমাট বাঁধা ভিড় সে কথা শুনলে তো! দুর্গানগরের ওই বাড়ি রাতারাতি যেন দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার ভিড় দেখে কারও কারও মনে হয়েছে, সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে বুঝি! সন্ধে নামার পরেও ভিড় পাতলা হয়নি। রাত আটটার পরে এক বার পুলিশ এসে পরিস্থিতি দেখে যায়। কৌতূহলীদের প্রশ্নের অন্ত নেই! এক জন এমনও জি়জ্ঞেস করলেন, ‘‘আচ্ছা, এই বাড়িতে কি ইন্দ্রাণী কখনও এসে থেকেছেন?’’ রেহাই পাননি বাবলির বাবা-মাও। তাঁদের বা়ড়িতেও এ দিন সকাল থেকে প্রতিবেশীদের ভিড়। নিরীহ প্রশ্নের ফাঁকে কেউ কেউ খোঁচা দিতেও ছাড়ছেন না, ‘‘আচ্ছা,আপনারা কিছু টের পাননি আগে?’’
অবাঞ্ছিত প্রশ্নবাণে ক্লান্ত, বিষণ্ণ বোধ করলেও স্বামীর পাশেই থেকেছেন বাবলি। বলেন, ‘‘১৯৯৭ সালে আমাদের বিয়ে হয়েছে। তার পর থেকে এই এলাকাতেই আছি। আমার স্বামীর মতো মানুষের সঙ্গে যিনি থাকতে পারেননি, আমি নিশ্চিত, তাঁর মধ্যে সংসার করার কোনও বাসনা ছিল না।’’ পুলিশ যদি সিদ্ধার্থবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনও রকম আইনি পথে যায়, সে ক্ষেত্রে আপনি কি ওঁর পাশে থাকবেন? বাবলির উত্তর, ‘‘আমি তো কোথাও যাইনি। ওঁর পাশেই আছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy