সস্ত্রীক সুন্দর। বেশ কয়েক বছর আগের ছবি। ফেসবুকের সৌজন্যে।
শান্তশিষ্ট, লাজুক ছেলেটাকে উপর থেকে দেখে আলাদা করে খুব নজরকাড়া মনে হতো না। কিন্তু তাকে কোনও প্রশ্ন করলেই ঝটিতি বেরিয়ে আসত ভিতরের শাণিত চেহারাটা। চটপট নিখুঁত উত্তরে একেবারে তাজ্জব হয়ে যেতেন শিক্ষকরা।
মেধাবী ছাত্র আইআইটি-তে অনেকেই থাকেন। কিন্তু মেটালার্জি অ্যান্ড মেটিরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র পি সুন্দররাজনের বি টেক স্তরের ‘থিসিস’-এও ছিল উদ্ভাবনী চিন্তার ছোঁয়া। পড়ার সময় থেকেই ঝোঁক ছিল বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ব্যবহৃত ধাতু (সিলিকন, গ্যালিয়াম) নিয়ে কাজ করার। এ সব দেখে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আইআইটি খড়্গপুরের শিক্ষক-অধ্যাপকদের অনেকে বলতেন, ‘‘এ ছেলে লম্বা রেসের ঘোড়া।’’ কিন্তু পিচাই সুন্দররাজনের (দুনিয়া যাঁকে সুন্দর পিচাই নামে চেনে) দৌড়টা যে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে গুগলের সিইও পদে পৌঁছে যাবে, এতটা বোধ হয় আশা করেননি তাঁরাও।
শান্ত ছেলেটা পড়াশোনার বাইরে ক্যাম্পাসে বেশি মেলামেশা করত না। তাই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনী গুগ্ল-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন শুনেও অনেকেই মনে করতে পারেননি তাঁকে। কর্পোরেট দুনিয়ায় পরিচিত সুন্দর পিচাইকে আইআইটি নথিপত্রেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মেটালার্জি অ্যান্ড মেটিরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সনৎ রায়ই মনে করিয়ে দেন, আইআইটি-র নথিপত্রে ওর নাম ছিল পি সুন্দররাজন। ১৯৯৩-এ মেটালার্জি অ্যান্ড মেটিরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বি টেক পাশ পি সুন্দররাজনই এখন নাম বদলিয়ে সুন্দর পিচাই!
মেধাবী সুন্দররাজনকে শিক্ষকেরা মনে রেখেছেন তাঁর অমায়িক ব্যবহারের কারণেও। সনৎবাবু বলছেন, ‘‘ধাতুবিদ্যার কঠিনতম বিষয়েও সড়গড়, ঝরঝরে ইংরেজি বলতে পারা সুন্দরের মধ্যে কোনও দেখনদারি ভাব ছিল না।’’ ছাত্রের এই অনবদ্য কীর্তির পরে উচ্ছ্বসিত কানপুর আইআইটি-র ডিরেক্টর অধ্যাপক ইন্দ্রনীল মান্না। তাঁর অধীনেই (তিনি তখন খড়্গপুরে মেটালার্জি বিভাগের শিক্ষক) স্নাতক স্তরের ‘থিসিস’ করেছিলেন সুন্দর। ইন্দ্রনীলবাবু বলছেন, ‘‘ল্যাবরেটরিতে যে কোনও সমস্যা লিখে ফেলতেও সুন্দরের জুড়ি মেলা ভার। এত ভাল লেখার হাত কম দেখা যায়।’’ তার সঙ্গে ছিল দুরন্ত স্মৃতিশক্তি। একসঙ্গে অনেক ফোন নম্বর মনে রাখতে পারতেন। সহপাঠীদের অনেকে বলছেন, ‘‘ও ছিল ছুপা রুস্তম।’’ কী রকম? ক্যাম্পাসেই সুন্দরের পরিচয় হয়েছিল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা অঞ্জলির সঙ্গে। পড়ার সময় দু’জনের প্রেম কিন্তু টেরই পাননি কেউ! পরে সেই অঞ্জলিই সুন্দরের ঘরণী। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বন্ধু ছিল। তার মধ্যে স্বামীনাথন বলে আর এক যুবকের কথা মনে আছে ইন্দ্রনীলবাবুর। মেধাবী স্বামীনাথন পরে জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি শেষ করার রাতেই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান।
আইআইটি ক্যাম্পাসে সুন্দরকে পড়ার বাইরে সে ভাবে দেখা না গেলেও টুইটারে কিন্তু তিনি ফুটবল থেকে সমকামী বিয়ে, সবেতেই সপ্রতিভ। টুইটারেই সুন্দরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে সত্য নাদেল্লা, টিম কুক সকলেই। সুন্দর এ দিন টুইটে মোদীকে উত্তরও দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘আশা করছি শিগগিরি আমাদের দেখা হবে!’’ সেপ্টেম্বরে সিলিকন ভ্যালিতে যাওয়ার কথা রয়েছে মোদীর। সেখানে তাঁর সঙ্গে সুন্দরের কথা হয় কি না, সে দিকেই এখন তাকিয়ে রয়েছেন সবাই। গত বছরে সুন্দরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শাহরুখ খানের। গত বছর অক্টোবরে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ছবির প্রচারে গুগ্ল-এর অফিসে গিয়েছিলেন শাহরুখ। বলেছিলেন, এক সময় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারই হতে চেয়েছিলেন তিনি। সুন্দরের পাল্টা প্রস্তাব ছিল শাহরুখের কাছে, ‘‘আপনি কি এখনও পেশা বদল করতে চান?’’
গুগ্ল অফিসেও সুন্দর জনপ্রিয় তাঁর এমনই অমায়িক ব্যবহারের জন্য। গুগ্ল-এর জনসংযোগ বিভাগের প্রাক্তন কর্ত্রী পরমা রায়চৌধুরী (বর্তমানে সফটব্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট) বলছেন, ‘‘গুগ্ল ক্রোম নিয়ে সুন্দরের সাক্ষাৎকার প্রয়োজন ছিল। ওকে বলতেই অনুরোধ করল, ৩০ মিনিট পরে কথা বলতে। কারণ, সে সময় ও বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছিল।’’ পরমা বলছেন, বড় কাজের মধ্যে ছোট ছোট ব্যাপারগুলোও কখনও সুন্দরের নজর এড়ায় না।
তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার শীর্ষে উঠে আসার পিছনে মেধার সঙ্গে অমায়িক ব্যবহারের রসায়ন তো রয়েইছে। আবার আইআইটি-র অন্দরে একটা অন্য রসিকতাও চলছে। ক্যাম্পাসের নেহরু হল-ও (বি টেক পড়ার সময় সুন্দরের ঠিকানা) নাকি এই চমকপ্রদ উত্থানের পিছনে অনেকটা দায়ী। বি টেক পড়ার সময় ওই বাড়িতে চার বছর থাকলে নাকি জীবনটা বদলে যেতে পারে! যার উদাহরণ হিসেবে উঠে আসছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক ছাত্রের নাম!
রেভিনিউ সার্ভিসের উঁচু পদ ছেড়ে ৪৭ বছর বয়সে যিনি এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী! অরবিন্দ কেজরীবাল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy