জানেন না কত দিন কাজ চলবে। মুম্বইয়ে। —নিজস্ব চিত্র।
স্যাকরার ঠুকঠাক করাই জানতেন এঁরা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যে এ ভাবে নোট বাতিলের নামে কামারের ঘা মেরে ব্যবসা লাটে তুলে দেবেন, তা ভাবতেই পারেননি জাভেরি বাজারের স্বর্ণব্যবসায়ী-কারিগরেরা। নোট বাতিলের পরে কেটে গিয়েছে প্রায় তিন বছর। এখনও সোনার ব্যবসার হাল তো ফেরেইনি, উল্টো নিত্য দিন কাজ হারাচ্ছেন সোনার কারিগরেরা। যাঁদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। তাই বেঁচে থাকার স্বার্থে এ বার বিজেপি-শিবসেনার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধেছেন মুম্বইয়ের বাঙালি সোনার কারিগরেরা। কী মুম্বইয়ে!
কী পশ্চিমবঙ্গে!
প্রথমে নোট বাতিল। তার পরে জিএসটি। জাভেরি বাজারের ঝাঁ-চকচকে শো-রুমগুলির পিছনে উঁকি মারলেই যে ভাঙাচোরা, বিবর্ণ, স্যাঁতস্যাঁতে তিন মহলা উঁচু বাড়িগুলির দেখা মেলা সেগুলি আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও ছিল কর্মচঞ্চল, প্রাণবন্ত, সজীব। সারা দিনই ভেসে আসত ঠুকঠাক শব্দ। গোটা জাভেরি বাজারের জৌলুসের পিছনে ছিলেন ওই বাড়িগুলির বিভিন্ন ঘরে বসে কাজ করা বাঙালি কারিগরেরা। কিন্তু মোদী সরকারের পাঁচ বছরের শেষে এখন বাড়িগুলিতে শ্মশানের স্তব্ধতা। যে ঘরগুলিতে আগে এক সঙ্গে পাঁচ-সাত জন বসে কাজ করতেন, সেই ঘর এখন তালাবন্ধ। কাজ না থাকায় কর্মীরা ফিরে গিয়েছেন দেশে। কোথাও কর্মী থাকলেও কাজ না থাকায় দিবানিদ্রাতেই দিন কাটছে তাঁদের। নিরুত্তর মুখগুলিতে একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে— কাজ পাওয়া গেল কিছু?
নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে বাজারে নগদ টাকার জোগান কমে যেতেই একটু একটু করে শেষে তলানিতে এসে ঠেকেছে ব্যবসা। ডোমজুড়ের বাসিন্দা রঞ্জিৎ পাড়ুই এখানে রয়েছেন প্রায় পনেরো বছর। প্রথমে কারিগর ছিলেন। পরে কাজ শিখে নিজেই কারিগর রেখে কাজ করা শুরু করেন। পাঁচ বছর আগে যেখানে তাঁর অধীনে দশ জন কাজ করতেন, এখন সেখানে কাজ করেন মাত্র দু’জন। তাও প্রতিদিন কাজ জোটে না। রঞ্জিতের কথায়, ‘‘আগে যেখানে ২০০ ভরির কাজ হত, এখন সেখানে ১০ ভরির কাজও জোটে না।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ফলে জাভেরি বাজার সংলগ্ন এলাকা ছাড়াও অন্ধেরি, ভায়েন্দর, বরিভেলি, ঠাণের মতো এলাকাগুলিতে যে তিন থেকে চার লক্ষ বাঙালি কারিগর বাস করতেন, তাঁদের অধিকাংশই ফিরে গিয়েছেন মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলি বা হাওড়ায়। কারিগরের নিপুণ হাতগুলো সেখানে গিয়ে টোটো চালাচ্ছে, মাটি কাটছে বা দিনমজুরি করছে। যাঁরা এখানে কাজ না পেয়ে রয়ে গিয়েছেন, তাঁরা কাজ জুটিয়েছেন ভাতের হোটেলে বা মেসবাড়িতে। সব মিলিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ভেঙে পড়ার মুখে স্বর্ণ শিল্প। জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি ফেডারেশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান জে ভি শ্রীধরন বললেন, ‘‘গত তিন বছরে স্বর্ণ শিল্পের কোনও উন্নতি তো হয়ইনি, উল্টে নেতিবাচক পথে হাঁটছে সেটা।’’ ক্ষুব্ধ ঘাটালের ব্যবসায়ী অনুপ মাইতির প্রশ্ন, ‘‘কালো টাকা ধরতে নোট বাতিল হল। সেই কালো টাকা কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর উচিত জবাব দেওয়া।’’ এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা জাভেরি বাজারেই। এমনকি যে কারিগরদের কল্যাণে দোকানগুলোর এত রমরমা ছিল, মাছি তাড়াচ্ছেন তাঁরাও। ভুলেশ্বর রোডে দোকানে বসে মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত স্বর্ণব্যবসায়ী জিতিন আহিরকর বললেন, ‘‘নোট বাতিলের পর থেকেই ব্যবসায় মন্দা। উপরন্তু জিএসটির বোঝা। সব মিলিয়ে খদ্দের ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। পুরো বাজারেই তার প্রভাব পড়েছে।’’
দক্ষিণ মুম্বইয়ের ওই ব্যবসায়ী এলাকায় শিবসেনার গতবারের জয়ী প্রার্থী অরবিন্দ সবন্তের বিরুদ্ধে এ বার দাঁড়িয়েছেন কংগ্রেসের মিলিন্দ দেওরা। এক দিকে ছোট ব্যবসাযীদের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। অন্য দিকে তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন খোদ মুকেশ অম্বানি-উদয় কোটাকরা। ফলে রীতিমতো অস্বস্তিতে শিবসেনা নেতৃত্ব। চর্নি ঘাট এলাকার শিবসেনার শাখা অফিসে বসে ছিলেন উপশাখা প্রধান প্রকাশ কাভানথা। স্বীকার করে নিলেন, নোট বাতিল এবং জিএসটির ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ী সমাজের ক্ষোভ রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ী সমাজের নিরঙ্কুশ সমর্থন পাওয়া যাবে না বলেই ধরে নিচ্ছে দল। তবে জেতার বিষয়ে নিশ্চিত তিনি। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দক্ষিণ মুম্বইয়ের ছ’টি বিধানসভার মধ্যে কোলাবা, ওরলি, মালাবার হিল ও লালবাগ— এই চারটি বিধানসভা এনডিএ-র হাতে রয়েছে। বিরোধীদের হাতে স্রেফ মুম্বাদেবীতে কংগ্রেস ও বইকালাতে এমআইএমের বিধায়কের আসন রয়েছেন।’’ সব মিলিয়ে জেতার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত প্রকাশ। কিন্তু তাঁদের চিন্তা, পাঁচ বছর বিজেপির সঙ্গে তুমুল মন কষাকষির পরে এখন নিচুতলায় জোট কতটা বাস্তবায়িত হবে। উপরন্তু রাহুলের ‘ন্যায়’ প্রকল্পও যে এনডিএ শিবিরকে বেশ চিন্তায় রেখেছে, তা মেনে নিচ্ছেন তিনি।
ব্যবসা গুটিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জুটেছে আরেক সমস্যা। যে বাড়িগুলিতে বসে কাজ করতেন স্বর্ণশিল্পীরা, সেগুলিতে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কায় বাসিন্দাদের নবি মুম্বইয়ে উঠে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল মুম্বই পুরসভা। বিষয়টি এখন আদালতের বিচারাধীন। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই মুম্বই পুরসভার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন মহাদেব দত্ত। ব্যবসা প্রায় বন্ধ। তাই ব্যস্ত আইনি লড়াইয়ে। দিস্তা-দিস্তা আইনের কাগজ নিয়েই এখন কারবার তাঁর। বললেন, ‘‘আমরা ছাড়লেই এখানে শপিং মল করবে। তাই সরে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। লড়াই চলবে।’’ এই লড়াইটাকেই ভয় পাচ্ছে বিজেপি-সঙ্গীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy