কবালের যন্ত্রণা ‘বদনামী’তে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাতারাতি একটা হনুমান মন্দির দু’দশটা জেলায়-শহরে বিখ্যাত হয়ে উঠবে, এমনটা এ তল্লাটে আগে কেউ ভাবেননি। কিন্তু ঘটেছে তেমনই। মন্দিরের নাম ‘সঙ্কটমোচন সিদ্ধপীঠ’। কিন্তু সেই মন্দিরের পূজারিই ঘোর সঙ্কটে পড়ে গিয়েছিলেন কয়েক মাস আগে। শামলি অড্ডার হনুমান মন্দিরটা তখন থেকেই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জাঠভূমির বর্ণহিন্দুরা এই খ্যাতিকে মোটেই ভাল চোখে দেখছেন না। তাতেই প্রমাদ গুনছেন জাঠ কুলপতি। তিন দশক আগে প্রয়াত বাবা তথা দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ছবিটাকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছেন চৌধরি অজিত সিংহ।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আচমকা বলে বসলেন হনুমানজি দলিত ছিলেন। তা নিয়ে দেশ জুড়ে কথা চালাচালি আর বিতণ্ডার ঝড় যা ওঠার, সে তো উঠলই। কাজের কাজটা করলেন মুজফ্ফরনগর শহরের এক দলিত যুবক। জনা বিশেক ছেলে-ছোকরা সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন শামলি অড্ডা মোড়ের হনুমান মন্দিরে। বললেন, দলিতের মন্দির, দলিতরাই পুজো করবেন। তার পরে পুরোহিতকে সরিয়ে নিজেই বসে গেলেন বিগ্রহের সামনে।
পুলিশ অত্যন্ত তৎপরতা দেখিয়েছিল সে দিন। একে সহারাণপুরে তথাকথিত উচ্চবর্ণের সঙ্গে দলিতদের সংঘর্ষ হয়ে গিয়েছে কিছু দিন আগে। তায় এই ঘটনাটা ঘটছে উত্তেজনাপ্রবণ মুজফ্ফরনগরে। কালক্ষেপ না করে শামলি অড্ডায় পৌঁছয় পুলিশ, দ্রুত খালি করে দেয় মন্দির।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গোটা শহর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানে ঘটনাটা, গোটা জেলা বা আশপাশের জেলাতেও তাই। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি)-র কোনও নেতা-কর্মীর সামনে প্রসঙ্গটা উঠলেই উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটে। কিন্তু জাঠ বা তথাকথিত উচ্চবর্ণের কারও কাছে ওই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলেই প্রথমে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে চাহনি, তার পরে চোয়াল শক্ত হয়। তবে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে বললেই তাঁরা সামলে নেন। বলেন, ‘‘দলিতরা তো আমাদের ভাই!’’
অজিত সিংহের সঙ্কটটা এই চোরাস্রোতেই। কৃষিপ্রধান পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের অধিকাংশ জমিই জাঠদের হাতে। অজিত সিংহরা বংশপরম্পরায় এই জাঠ তথা কৃষকদের প্রতিনিধি হিসেবেই নিজেদের তুলে ধরে আসছেন। আর সামাজিক সমীকরণে জাঠ, দলিত এবং সংখ্যালঘু যেন তিনটে আলাদা আলাদা মেরু এই অঞ্চলে। মায়াবতী বা অখিলেশের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভরসা রেখে দলিত এবং মুসলিমের ভোট এক জায়গায় এসেছে কখনও কখনও। কিন্তু বড়সড় সাম্প্রদায়িক হিংসার সাক্ষী যে মুজফ্ফরনগর, সেখানে এই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে জাঠদের সামিল করা কঠিন। সেই কঠিন কাজটাই অজিত সিংহকে করতে হচ্ছে এ বার। কারণ এসপি-বিএসপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর দল আরএলডি এখন মহাগঠবন্ধনের অংশ এবং চৌধরি অজিত সিংহ নিজে প্রার্থী মুজফ্ফরনগর আসন থেকে।
কাছেই মেরঠ-বাগপত অঞ্চল, উত্তরপ্রদেশের জাঠ রাজধানী এবং অজিত সিংহের খাসতালুক। জোটের কল্যাণে মেরঠ আসন ছেড়ে দিতে হয়েছে বিএসপি-কে। আর যে আসন থেকে বার ছয়েক জিতে সংসদে গিয়েছেন অজিত সিংহ, সেই বাগপত তিনি এ বার ছেড়েছেন ছেলে জয়ন্ত চৌধরিকে। নিজে চলে এসেছেন মুজফ্ফরনগরে। তরুণ পুত্রের জয় সুনিশ্চিত করতেই এই বন্দোবস্ত চৌধরি অজিত সিংহের। একই রকম সাহারা নিজের বাবার কাছ থেকেও বোধহয় প্রত্যাশা করছেন অজিত। তাই মুজফ্ফরনগরে আরএলডি-র প্রচারে দলীয় প্রতীক ‘নলকূপ’-এর দেখা মিলুক বা না মিলুক, দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধরি চরণ সিংহের ছবি যাতে অবশ্যই দেখা যায়, তার ব্যবস্থা সযত্নে হচ্ছে। আরএলডির নেতা-কর্মীরা নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িতেও চৌধরি চরণ সিংহের ছবি লাগিয়ে ঘুরছেন।
গাড়িতেও চৌধরি চরণ সিংহের ছবি। নিজস্ব চিত্র।
অজিত সিংহের রাজনৈতিক যাত্রাপথে চরণ সিংহ এই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন, এমন কিন্তু নয়। বিস্তীর্ণ জাঠ বলয়ে অজিতের যা কিছু প্রতিপত্তি, সে সবই চরণ সিংহের ছেলে হিসেবে। বাবার উচ্চতায় তিনি কোনও দিনই তুলতে পারেননি নিজেকে। বাবার উত্তরসূরি হিসেবেই জাঠ জনভিত্তি ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন চিরকাল। কখনও সফল হয়েছেন, কখনও হননি। এ বার কী হবে, বলা খুব শক্ত। কারণ মুজফ্ফরনগরের বিদায়ী সাংসদ তথা বিজেপি প্রার্থী সঞ্জীব বালিয়ানও জাঠ নেতা এবং নিজের সম্প্রদায়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী তিনি। দুই জাঠের মুখোমুখি যুদ্ধে ভোটব্যাঙ্কে যে আড়াআড়ি বিভাজন ঘটে যেতে পারে, তা এখন থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ‘বিরোধী মানেই নন দেশদ্রোহী’, পাঁচ বছর পরে নিজের ব্লগে বিস্ফোরক আডবাণী
শামলি অড্ডা মোড়ে দাঁড়িয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী সঞ্জীব আগরওয়াল বলছেন, ‘‘জাঠদের মধ্যে যাঁরা বয়স্ক, যাঁরা চরণ সিংহকে দেখেছেন, তাঁর কাজ সম্পর্কে জানেন, তাঁরা অজিত সিংহের সঙ্গে রয়েছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্ম বালিয়ানের দিকে। তাঁরা বালিয়ানের হয়ে রাস্তাতেও নেমে পড়েছেন।’’ একই কথা শোনাচ্ছেন মন্দিরের তরুণ পুরোহিতও, বালাজি চকের মাঝবয়সি কাচের চুড়ি বিক্রেতাও।
চরণ সিংহের ছবি তুলে ধরে তা হলে লাভটা কী হচ্ছে? সংশয়ের ভঙ্গিতে চোখ ছোট হয়ে আসে সঞ্জীব আগরওয়ালের। বলেন ‘‘বালিয়ান খুব তাগড়া নেতা তো, ওই ছবি না দেখালে বয়স্কদের ভোটটাও কি পাবেন অজিত...।’’
লড়াই যখন দুই জাঠ নেতার মধ্যে, তখন মুজফ্ফরনগরের অন্যতম নির্ণায়ক শক্তি দলিত সমাজ কী ভাবছে? তিক্ততা ঠিকরে আসে ক্ষেতমজুর অরবিন্দ বাল্মিকীর গলা থেকে। ‘‘ছোটা নাঙ্গলায় এই জাঠরাই তো দলিত সমাজের পাঁচ জনকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে দিয়েছিল। তখন তো দাঙ্গা হয়নি! কিন্তু জাঠের ছেলের গায়ে হাত পড়তেই দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। জাঠের ছেলে মরতেই সব হিন্দু এক হয়ে গেল। আমরা কি হিন্দু নই?’’
এই অরবিন্দ বাল্মিকীর ভোট যে সঞ্জীব বালিয়ান পাবেন না, তা নিয়ে সংশয় কমই। কিন্তু নিজের ভোটব্যাঙ্কে বড়সড় বিভাজন ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা জাঠ কুলপতি অজিত সিংহ তো দলিত ভোটের ভরসাতেই হিসেব কষছেন। ভোটযুদ্ধ সম্পর্কে সেই দলিতই নিস্পৃহ হয়ে গেলে চৌধরিজির হিসেব মিলবে কী ভাবে?
শুধু চরণ সিংহের ছবিতে কাজ হবে তো? নাকি মায়াবতীর ছবিটাও বুকে নিয়ে ঘুরতে হবে অজিতকে? ঠা-ঠা দুপুরে আরএলডি-র নির্বাচনী কার্যালয়ের সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকা সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা টুপির (চরণ সিংহের মতো) বিশালদেহী প্রবীণের কপালে দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy