বৃহস্পতিবার মাঝরাতে লালুপ্রসাদের বাড়ি গিয়ে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করলেন নীতীশ কুমার। আর শুক্রবার সন্ধ্যাতেই ‘সুখবর’ এল!
বিহারে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে দীর্ঘদিনের বিবাদ ভুলে ফের কাছাকাছি এসেছেন লালু-নীতীশ। বিজেপির বাড়বাড়ন্ত রুখতে একজোট হয়েছেন। কিন্তু সম্পর্কে চিড় যে থেকেই গিয়েছে, তা স্পষ্ট হয়েছে গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে। গত বুধবার রহিম দাসের একটি দোঁহা টুইট করেছিলেন নীতীশ। যাতে বলেছিলেন, সাপ চন্দন গাছকে জড়িয়ে থাকলেও গাছের কোনও ক্ষতি হয় না। তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে যায় জল্পনা। অনেকেই বলতে শুরু করেন, লালুর সঙ্গে জোটকে লক্ষ্য করেই এমনটা লিখেছেন নীতীশ। কারণ নীতীশের সঙ্গে সমঝোতার পরে লালু মন্তব্য করেছিলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোখার জন্য তিনি বিষ খেতেও রাজি। যদিও নীতীশ ব্যাখ্যা দেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল বিজেপি।
কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় যে চিঁড়ে ভেজেনি, সেটা বোঝা যায় গত কাল। লালুও মোদীকে উপলক্ষ করে নীতীশকে বেঁধেন। সমালোচনা করেন বড় বড় ছবি দিয়ে ভোট প্রচারের। উষ্মা প্রকাশ করেন ঘনিষ্ঠ মহলেও। আর তার পরেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রাতে সচিবালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে লালুর বাড়িতে হাজির হন নীতীশ। ঘণ্টা দেড়েক বৈঠকের পরে লালু জানিয়ে দেন, ‘কনফিউশন শেষ’।
‘কনফিউশন’ না-থাকলে জেডিইউ-আরজেডি-কংগ্রেস জোটের যে আখেরে লাভই হবে, সেটা আজ এবিপি নিউজ-নিয়েলসেনের প্রাক্-ভোট জনমত সমীক্ষা থেকেও উঠে এসেছে। সমীক্ষা বলছে, বিধানসভার ২৪৩টি আসনের মধ্যে ১২৯টিতে এগিয়ে রয়েছে লালু-নীতীশের জোট। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট এগিয়ে রয়েছে ১১২টি আসনে। বাকি দু’টি আসনে এগিয়ে নির্দলরা।
এটা ঠিক যে বিহারে বিধানসভা ভোটের এখনও প্রায় চার মাস বাকি। সেই ভাবে প্রচারও শুরু হয়নি। এখনও আসরে নামেননি রথী-মহারথীরা। সবে জনসংযোগ শুরু করেছেন লালু, নীতীশ, অমিত শাহেরা। আগামিকাল প্রথম দফায় রাজ্যে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভোটের উত্তাপ যত বাড়বে, ততই পাল্টাবে জনমতের ছবিটা। তা ছাড়া অভিজ্ঞতা বলছে, জনমত সমীক্ষার ফল সব সময় মেলেও না। তবু ভোটদাতাদের মানসিকতার আঁচ পেতে এই ধরনের সমীক্ষার একটা গুরুত্ব আছে। এবং প্রথম সমীক্ষায় এগিয়ে থাকার ইঙ্গিত পেয়ে উজ্জীবিত বিজেপি-বিরোধী শিবির। আর বিজেপি প্রত্যাশিত ভাবেই বলেছে, খেলা অনেক বাকি।
এক বছর আগে লোকসভা ভোটে বিহারে ৪০টি আসনের মধ্যে ৩১টিতে জিতেছিল এনডিএ। তখন লালু-নীতীশ প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তা সত্ত্বেও বিজেপি-বিরোধীদের সম্মিলিত ভোটের পরিমাণ ছিল ৪৫ শতাংশ। আর এনডিএ পেয়েছিল ৩৬ শতাংশ ভোট। ফলে বিজেপি-বিরোধী শক্তিকে একজোট করলে যে মোদী-ঝড় ঠেকানো সম্ভব, সেটা বুঝেছিলেন নীতীশ। তার পর বিধানসভার উপনির্বাচনে কংগ্রেস এবং আরজেডি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফলও পেয়েছেন তিনি।
বিধানসভা ভোটে জোট করার ব্যাপারে লালু অবশ্য গোড়ায় দোনামনা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের চাপে তাঁকে রাজি হতে হয়েছে। কিন্তু মনোমালিন্য পুরোপুরি মেটেনি। সাপ-চন্দন বিতর্ক আবার তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে। এই অবস্থায় শান্তিপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন নীতীশ। কারণ, জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তিনিই। দায় তাঁরই বেশি।
নীতীশের মন্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন লালু। গত কালই নিজের বাড়িতে ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘‘যৌথ নেতৃত্ব ছাড়া বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই সম্ভব নয়। অথচ নীতীশ কুমার সে পথে হাঁটছেন না। উল্টে আমাকে ‘উন্নয়ন-বিরোধী’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন।’’ লালুর ক্ষোভের কথা জানার পরেই আরজেডি প্রধানের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন নীতীশ। ১০ সার্কুলার রোডের বাসিন্দা মুখ্যমন্ত্রী রাত সওয়া দশটা নাগাদ চলে যান ৭ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা লালুর কাছে। নীতীশের আসার খবর আগে থেকে জানতেন না লালু। তিনি তখন রাতের খাওয়া সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আপ্ত সহায়কের কাছ থেকে খবর পেয়ে তৈরি হয়ে নেন তিনি। নীতীশ আসার পরে একান্তে আলোচনা করেন তাঁর সঙ্গে।
বৈঠকের খবর পেয়ে তত ক্ষণে লালুর বাড়ির সামনে হাজির সাংবাদিককুল। পৌনে বারোটা নাগাদ তাঁদের এড়িয়েই গাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন নীতীশ। কিন্তু লালু তাঁকে নামিয়ে এনে পাশে টেনে ‘ফটো সেশন’ শুরু করেন। অনেকের ধারণা, লালুর সঙ্গে বৈঠকের কথাটা গোপনই রাখতে চেয়েছিলেন নীতীশ। সেই কারণে সন্ধ্যায় যখন চাউর হয়েছিল, তিনি আরজেডি প্রধানের বাড়িতে যেতে পারেন, তখন তার সত্যতা স্বীকার করেনি মুখ্যমন্ত্রীর দফতর। লালু-শিবিরই সাংবাদিকদের খবর দেয়। তবে ফটো-পর্ব শেষে লালুর মতো সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় না-মেতে বাড়ি চলে গেলেও নীতীশের শরীরী ভাষা বলে দিচ্ছিল, মোটের উপর আশ্বস্ত তিনি।
আর লালু সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘বিজেপি নানা রকমের কথা বলছে। প্রথমে বলত, আমরা এক হব না। এখন বলছে এক হলেও আসন নিয়ে গোলমাল হবে। আমরা দু’জনেই বিজেপিকে তাড়ানোর জন্য এক হয়েছি। এবং তা করেই ছাড়ব।’’ পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ মহলে লালু বলেছেন, এই ভোটে জেতাটা তাঁর থেকেও নীতীশের বেশি দরকার। আরজেডি-র সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে চাইলে ফল যে ভাল হবে না, সেটাই নীতীশকে বুঝিয়েছেন তিনি।
গত ক’দিন ধরে লালু-নীতীশ দ্বৈরথ নিয়ে যে বিজেপি নেতারা চনমনে হয়ে উঠেছিলেন, বৈঠকের খবরে তাঁরা একটু হতাশই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিহার নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা অনন্ত কুমার অবশ্য কটাক্ষ করেছেন, ‘‘নীতীশ কুমার দিনের বেলায় লালুপ্রসাদের বিরুদ্ধে টুইট করেন। আর রাতে গিয়ে দেখা করেন। এর থেকেই দু’জনের সম্পর্ক আর জোটের ভবিষ্যত্ বোঝা যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy