হাল ধরলেন। মঙ্গলবার নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে কিষান চ্যানেলের উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
দুর্নীতি দমনই কি এক বছরের একমাত্র সাফল্য! সুদিন কি শুধু দুর্নীতি দমনেই সীমাবদ্ধ?
তা না হলে সরকারের বর্ষপূর্তির লগ্নে গত কাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর আজ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ওই বিষয়টিকেই বড় করে তুলে ধরলেন কেন? উত্তরপ্রদেশে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের গ্রামের জনসভায় বিরোধীদের নিশানা করতে গিয়ে মোদী বলেছেন, কংগ্রেস আরও এক বছর ক্ষমতায় থাকলে কী ভাবে আরও লুঠ হতো, আরও কত জন জেলে যেত, আরও কোন নেতার জামাইয়ের দুর্নীতি সামনে আসত। আজ দিল্লিতে দলের সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলনেও একই সুর ছিল অমিত শাহের গলায়। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও দাবি করেছেন, ইউপিএ জমানার মতো নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকে এখন আর দালালদের ঘুরতে দেখা যায় না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু দুর্নীতি দমন মানেই কি সুদিন। দালালতন্ত্র ঘোচানো মানেই কি সুশাসন? এ দেশে যাঁদের দালাল বলে ছোট চোখে দেখা হয়, পশ্চিমী দেশগুলিতে তাঁরাই সরকারি কাজে বড় ভূমিকা পালন করেন। আমেরিকায় সত্তরের দশক থেকেই মার্কিন কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য ‘লবি’ করা হয়। সে দেশের সংবিধানেই এর অনুমোদন রয়েছে। নির্ধারণ করা আছে আইনি সীমারেখাও। প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই মতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ থাকে, তা হলে কোনও ব্যক্তি বা বেসরকারি সংস্থার হয়ে ‘লবি’ করার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই।
কিন্তু ঘটনা হল, এ দেশে দুর্নীতি বন্ধ করার নামে সিদ্ধান্ত নেওয়াই বন্ধ হয়ে যায় অনেক সময়। এই প্রসঙ্গে দিল্লির আমলাদের অনেকে তুলে ধরেন দ্বিতীয় ইউপিএ জমানার প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির কথা। অ্যান্টনি আগাগোড়া সৎ বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রায় কোনও সিদ্ধান্ত নিতেন না। অস্ত্রশস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ঘুষ-দালালি আদানপ্রদানের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বফর্স কেলেঙ্কারি যার অন্যতম। অ্যান্টনি এর ছোঁয়া থেকে গা বাঁচাতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কেনাকাটা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন। যার জেরে তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে গোলাবারুদের সঞ্চয়। দশ দিনের বেশি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার রসদ নেই সেনাবাহিনীর হাতে।
শুধু কেন্দ্র নয়, রাজ্যেও দুর্নীতি রুখতে গিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার নজির প্রচুর। পশ্চিমবঙ্গেই জ্যোতি বসুর জমানা দুর্নীতিমুক্ত বলে পরিচিত। কিন্তু সেই আমলে কাজের যে কিছু হয়নি, রাজ্য কার্যত এগোয়নি— সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কর্তাদের মতে, দুর্নীতি দমন নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু তার জেরে সিদ্ধান্ত নেওয়াই বন্ধ করে ফেলা কোনও কাজের কথা নয়। সাহস করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাতে দু’একটা ভুলভ্রান্তি হলে হোক।
বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্রের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘এই যুক্তি মানলে তো প্রশ্ন উঠবে, সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হলে কি দুর্নীতিকেও গা সওয়া করে ফেলতে হবে? ঠিক যেমনটি হয়েছিল ইউপিএ জমানাতে। এ জমানায় তেমনটা ঘটলে বিরোধী থেকে সংবাদমাধ্যম কি ছেড়ে কথা বলবে?’’ প্রশাসনের কর্তারা পাল্টা বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য সৎ থাকাটাই আসল কথা। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলেই দুর্নীতি দমনের কাজ বারো আনা সারা হয়ে যায়। কিন্তু তার বদলে দুর্নীতির ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে, স্বচ্ছতা নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে দেখা দেয় নীতিপঙ্গুত্ব।
ইউপিএ জমানার নীতিপঙ্গুত্ব কাটানোর আশা নিয়েই বিজেপি-কে ক্ষমতায় এনেছিল দেশবাসী। গত তিরিশ বছরের মধ্যে প্রথম বার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে। কিন্তু গত এক বছরে প্রায় কোনও সাহসী সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি মোদী সরকার। সংস্কারের প্রায় সব কর্মসূচিই থমকে। গত কাল তাঁর সরকারের রিপোর্ট কার্ড পেশ করার সময় সংস্কার নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি প্রধানমন্ত্রী। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতির জড়তা কাটাতে ব্যর্থ মোদী সরকার। দেশের বাজারে চাহিদা নেই। রফতানিও কমেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের কাছ থেকে যে সাহসী সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিত ছিল, এখনও পর্যন্ত তা দেখা যায়নি। ইউপিএ আমলের অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম তো কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘সরকারের তো কোনও দিশাই নেই। দিশা থাকলে তো প্রথমে নীতি তৈরি হবে, তার পরে তার বাস্তবায়ন।’’
দিল্লির রাজনীতিকদের অনেকেই বলছেন, ‘গরিব-বিরোধী’ ও ‘কর্পোরেট বন্ধু’ আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রচার রাহুল গাঁধী তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব শুরু করেছেন, তার থেকে গাঁ বাঁচাতেই এখন ব্যস্ত মোদী-জেটলিরা। ভাবমূর্তি সামাল দিতে শিল্পমহলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছেন তাঁরা। যার প্রতিফলন ঘটেছে এইচএসবিসির কর্ণধার নয়না লাল কিদোয়াইয়ের বক্তব্যে। তাঁর অনুযোগ, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে বড় শিল্পসংস্থার কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন, কিন্তু দেশের শিল্পপতিদের সঙ্গে করেন না। অথচ দেশের শিল্পপতিদের সঙ্গে কথা বললে সেটি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ হয় না। ব্যবসা সব সময়ই হয় মানবিক সংযোগের মাধ্যমে। পরিবর্তে সরকার দূরত্ব তৈরি করছে।
বিষয়টি মানছেন সরকারের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্র্যহ্মণ্যম। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে ইউপিএ আমলে দুর্নীতি ও নীতিপঙ্গুত্বের একটি ছায়া তো আছে। সরকার এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এগোচ্ছে। তার জন্য কিছু সতর্ক পদক্ষেপও করতে হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটি ভারসাম্য আসবে।’’
জেটলি কিন্তু মনে করেন, দুর্নীতি রোধই সরকারের সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়। তাঁর মতে, ‘‘ক্ষমতার অলিন্দে এত দিন ধরে চলে আসা দুর্নীতির জাল এক বছরের মধ্যে মিটিয়ে ফেলা কম কথা নয়। কিন্তু বাদবাকি ক্ষেত্রে সরকার হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে, এমন তো নয়। এক বছরের মধ্যে অনেকগুলি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার ফল আসতে শুরু করেছে।’’ তা হলে সরকার ও দল কেন শুধু দুর্নীতি দমনের সাফল্যকেই বড় করে দেখাচ্ছে? অমিত শাহের যুক্তি, ‘‘আগের জমানার সঙ্গে তুলনা টানতে হচ্ছে, কারণ কংগ্রেস এখনও মিথ্যা প্রচার করে যাচ্ছে। তাই তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে, তাদের সময় কী ছিল, আর আজ কী আছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy