সাড়ে চার দশকের ইতিহাসে কি প্রথম মহিলা সভাপতি পেতে চলেছে বিজেপি? ঘটনাপরম্পরা এবং সাংগঠনিক ইঙ্গিত তেমনই আলোচনার জন্ম দিয়েছে বিজেপির অন্দরমহলে। মহিলা, অনগ্রসর শ্রেণি এবং আসন্ন বিহার নির্বাচনের ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ প্রভাব ফেলতে সক্ষম— এই সবের সমন্বয়ে এমন একটি নাম ভাসতে শুরু করেছে নয়াদিল্লির দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের বাতাসে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। তা নির্ভর করছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের উপর, যে শেষ মুহূর্তে তাঁরা কাহিনিতে কোনও ‘মোচড়’ দেন কি না।
কিন্তু যে নাম নিয়ে জল্পনা চলছে, সেই জল্পনার পিছনে কিছু যুক্তি, কারণ এবং সূচক রয়েছে। মোদী-শাহেরা গোটা দেশে বার্তা দিতে চান যে, বিজেপি শুধু বর্ণহিন্দুর দল নয়, সমান ভাবে অনগ্রসর শ্রেণিরও প্রতিভূ। তাঁরা বার্তা দিতে চান, বিজেপি মহিলাদের ক্ষমতায়নেও সবচেয়ে অগ্রগণ্য। প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে ওবিসি সম্প্রদায়ের। দ্রৌপদী মুর্মু দেশের ইতিহাসে প্রথম জনজাতি সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রপতি। উপরন্তু তিনি মহিলা। তাঁর আগেই দলিত নেতা রামনাথ কোভিন্দকে রাষ্ট্রপতি করেছিল বিজেপি। কিন্তু সরকারে বা সাংবিধানিক পদে দলিত, অনগ্রসর, জনজাতি বা মহিলাদের পাঠালেও নিজেদের দলের সর্বোচ্চ পদে কখনও কোনও মহিলাকে বিজেপি বসাতে পারেনি। বিজেপিতে মোদী-শাহ যুগ চলাকালীন সেই ‘মাইলফলক’ ছুঁয়ে ফেলার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে বলে খবর। এবং এমন এক মহিলার নাম আলোচনায় এসেছে, যিনি বিহারের আসন্ন নির্বাচনে জাতপাতের সমীকরণেও প্রভাব ফেলতে পারেন বলেই বিজেপির চিন্তকদের অনেকের ধারণা।
তবে বিজেপির ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনও মহিলা ‘সভাপতি’ পদ পাননি। তাই সেই বিষয়েও এখনও কেউ নিশ্চিত নন। ঘটনাপরম্পরা এবং সাংগঠনিক সমীকরণে কিছু ইঙ্গিত পেয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের সেই অংশ মনে করছে, পরিস্থিতির ‘নাটকীয়’ বদল না-হলে দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন এক মহিলাই।
আরও পড়ুন:
যাঁর নাম নিয়ে বিজেপির অন্দরে আলোচনা চলছে, জাতীয় রাজনীতিতে সে ভাবে পরিচিত না হলেও তিনি বিজেপির সর্বোচ্চ সাংগঠনিক কমিটি ‘সংসদীয় বোর্ডে’ একমাত্র মহিলা মুখ। সেই বোর্ডে তিনি স্থান পেয়েছেন নিতিন গডকড়ী এবং শিবরাজ সিংহ চৌহানের মতো নেতার ‘পরিবর্ত’ হিসেবে। তবে এতটাই নিঃশব্দে তিনি সংসদীয় বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন যে, বিভিন্ন রাজ্যের প্রথম সারির বিজেপি নেতারাও অনেক দিন পর্যন্ত তা খেয়াল করেননি। ২০২২ সালে ওই বোর্ডে নেওয়া হয় তাঁকে। সুষমা স্বরাজ ছাড়া তিনিই একমাত্র মহিলা, যাঁকে সংসদীয় বোর্ডের সদস্য করেছে বিজেপি। দলের আর এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংগঠন ‘জাতীয় নির্বাচন কমিটি’তেও রয়েছেন তিনি। তার থেকেই অনেকে উপসংহার টানছেন যে, তাঁকে ‘বড়’ ভূমিকার জন্য তৈরি রাখা হয়েছে।
হরিয়ানার সেই নেত্রীর নাম সুধা যাদব। মোদীর হাত ধরেই তাঁর রাজনীতিতে উত্থান।
আইআইটি-রুড়কি থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর। সেখান থেকেই ১৯৯২ সালে পিএইচডি করেন সুধা। ১৯৯৯ সালে প্রথম বার ভোটে লড়েন। সংসদীয় রাজনীতির ময়দানে সুধার পদার্পণ ঘটে মোদীর হাত ধরেই। তখন মোদী দলের তরফে হরিয়ানার পর্যবেক্ষক। সুধাকে মহেন্দ্রগড় লোকসভা আসনে প্রার্থী করেছিলেন মোদী। জীবনের প্রথম নির্বাচনে লড়েই ‘জায়ান্ট কিলার’ তকমা পেয়ে যান সুধা। কারণ, রাও ইন্দ্রজিৎ সিংহের মতো হেভিওয়েট কংগ্রেস প্রার্থীকে (এখন তিনি বিজেপিতে) ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছিলেন সুধা। পরবর্তী দু’টি লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য সুধা মহেন্দ্রগড় থেকে হেরে যান। সেই দুই নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-ও গোটা দেশে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-র কাছে হেরেছিল। সুধার উত্তরণ আবার শুরু হয় ২০১৪ সালে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে। ২০১৫ সালে সুধাকে বিজেপির ওবিসি মোর্চার কেন্দ্রীয় ইনচার্জ করা হয়। ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত জাতীয় অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন তিনি।
ঘটনাচক্রে, সুধার স্বামী কার্গিল যুদ্ধে ‘শহিদ’ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ডেপুটি কমান্ড্যান্ট। নাম সুখবীর সিংহ যাদব।

সুধা যাদবের পুত্র সিদ্ধার্থের বিয়ের অনুষ্ঠানে মোদীর উপস্থিতি অনেককে চমকে দিয়েছে। ছবি: সমাজমাধ্যম থেকে।
সুধাকে নিয়ে জল্পনা বেড়েছে ১ মার্চের পর থেকে। ওই দিন সন্ধ্যায় তাঁর পুত্র সিদ্ধার্থের বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। দলের নেতা-নেত্রীদের পরিবারে এ ধরনের অনুষ্ঠানে মোদী যান না, এমন নয়। কিন্তু খুব বাছাই করে। সুধার পরিবারের অনুষ্ঠানে মোদীর উপস্থিতিকেও এক ধরনের ‘সূচক’ হিসেবে ধরছেন অনেকে।
বিজেপি সূত্রের খবর, তিনটি বিষয় মাথায় রেখে সুধার নাম এসেছে—
ওবিসি ভোটব্যাঙ্কের স্থায়ীকরণ
বিজেপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্ণহিন্দু ভোটের সিংহভাগ (বিশেষত উত্তর ভারতে) বিজেপির দিকেই থেকেছে। দলিত এবং জনজাতি ভোট বিজেপি কখনও বেশি পেয়েছে, কখনও কম। এখনও সেই প্রবণতা আছে। কিন্তু ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার বিভিন্ন নির্বাচনে বিজেপির ঝুলিতে ওবিসি ভোট গিয়েছে। তাই চেষ্টা করলে ওবিসি সমাজকে দলের ‘স্থায়ী’ ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করা যেতে পারে বলে বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব মনে করছেন।
মহিলা ভোটব্যাঙ্ক
গত এক দশকে মহিলাদের ভোট যথাসম্ভব টানার উপরে জোর দিয়েছে বিজেপি। আইনসভায় মহিলাদের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে সংসদে ‘নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম বিল’ পাশ করানো হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’-এর অনুকরণে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির কোথাও ‘লাডলি লক্ষ্মী’, কোথাও ‘লাডকি বহিন’ যোজনা চালু হয়েছে। চালু হয়েছে মহিলাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক উদ্যোগে উৎসাহ দিতে ‘লাখপতি দিদি’র মতো প্রকল্প। তবে তার ফলে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র বা হরিয়ানায় বিজেপির ঝুলিতে মহিলা ভোট আগের চেয়ে বেশিও পড়লেও একে স্থায়ী প্রবণতা বলে ভাবছে না বিজেপি। মহিলা ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে প্রথম বার কোনও মহিলাকে দলের সভাপতি পদে বসানোর উদ্যোগ সেই ভাবনা থেকেও হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
বিহারের যাদব ভোট
চলতি বছরের শেষেই বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। বিহারের যাদব ভোটের বাক্সে সুধার ‘পদবি’ প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। নীতীশ কুমারের কুর্মি, বিজেপির ক্ষত্রিয়-ভূমিহার, চিরাগ পাসোয়ান ও জিতন মাঝির দলিত-মহাদলিত ভোট এনডিএ-র ঝুলিতে পড়লে বিহার ধরে রাখা মোদী-শাহের পক্ষে কঠিন নয়। কিন্তু নীতীশের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়াও রয়েছে। তাই বিহারের মূল প্রতিপক্ষ আরজেডির ‘বাঁধা’ ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত যাদব ভোটে বিজেপি প্রভাব ফেলতে চায়।