ঠিক ১৮ বছর আগে এমনই এক ডিসেম্বরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিরিশ বছর বয়সী এক যুবক জেলের দিকে পা বাড়িয়েছিল। তখন সে কট্টর জঙ্গি নেতা। বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সে অস্ত্র আর অর্থ সংগ্রহ করছিল।
তার পর ব্রহ্মপুত্র আর যমুনায় অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ভিনদেশের কারাগারে কেটে গিয়েছে সময়। কারাবাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও প্রাণভয়ে স্বভূমে ফিরতে চাননি আলফার সাধারণ সম্পাদক গোলাপ বরুয়া ওরফে অনুপ চেতিয়া। অবশেষে এই বছর ভারতে ফেরা। চারটি মামলায় জামিন মেলার পরে গত কাল বিকেলেই জেল থেকে বেরিয়েছেন তিনি। দুর্দম সেই বিপ্লবী যুবক এখন চুলে পাক ধরা, দাঁত পড়ে যাওয়া, মিতভাষী প্রবীণ। গলায় মাফলার জড়ানো।
গুয়াহাটির আদালতে প্রথম দিন দেখা করতে আসার সময় নিজের স্ত্রীকেই চিনতে পারেননি। ভুলে গিয়েছেন সন্তানদের চেহারাও। কিন্তু আলফার সংগ্রাম বা ভারত-অসম সমস্যা নিয়ে আবেগটা ঠিক একই রকম রয়েছে। আলফার আলোচনাপন্থী সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে ভারতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেও খোলাখুলি পরেশ বরুয়ার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানান চেতিয়া। একই সঙ্গে আশ্বস্ত করেন, আগের বারের মতো আর সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ফিরবেন না। বরং কথা বলবেন পরেশের সঙ্গে।
গুয়াহাটি থেকে তিনসুকিয়ার জেরাই গাঁওতে যাওয়ার পথে রাস্তায় সোনাপুর-সহ বিভিন্ন স্থানে সংবর্ধনা পেলেন চেতিয়া। ঘরে ফেরার পথেই প্রথম বার সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিলেন আলফার সাধারণ সম্পাদক।
- মুক্তি পেয়ে কেমন লাগছে? এত দিন ধরে বিদেশের মাটিতে থেকে কি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন?
- বাংলাদেশের কারাগার থেকে বেরোবার পরেই মুক্তির স্বাদ পেয়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ পেরিয়ে যখন মেঘালয়ের দাউকিতে ঢুকি, তখন প্রাণভরে স্বদেশের গন্ধ নিয়েছি। ভেবেছিলাম, ওখান থেকে সোজা গুয়াহাটি আসব। কিন্তু পথে মত বদল করে সিবিআই আমায় দিল্লি নিয়ে যায়। তবু হতাশ হইনি। জানতাম, ফাঁসির সাজা যখন হয়নি, তখন মুক্তি এক দিন পাবই। শুধু আমার আর বাবুলের (চেতিয়ার কারাবাসের সঙ্গী, আলফা সদস্য মনোজ গোস্বামী) চিন্তা ছিল লক্ষ্মীকে (লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামী, কারাবাসের আর এক সঙ্গী) নিয়ে। ও অসুস্থ ছিল, মানসিক অবসাদে ভুগছিল। দিল্লি থেকে গুয়াহাটির কারাগারে এসে অসমিয়া ভাষায় কথা বলে বাঁচলাম। তবে, বাংলাদেশের কারাগারের কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবীরাও আমার সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার করেছেন।
-স্ত্রী মণিকাকে প্রথম দর্শনে চিনতে পারেননি?
-সত্যি, খুবই লজ্জিত ওই ঘটনার জন্য। আসলে ১৯৯৫ সালে স্ত্রীকে নিয়ে অসম ত্যাগ করি। আমি গ্রেফতার হই ১৯৯৭ সালে। তখন মেয়ে বুলবুলির দু’বছর বয়স, ছেলে জুমনের সাত বছর। বউয়ের মাথায় একঢাল চুল, স্বাস্থ্যও ভাল। কিন্তু গুয়াহাটির আদালতে আসা মণিকার চুল কাটা, রোগা। তাই প্রথমে একেবারে চিনতে পারিনি। আমার ছেলে আর মেয়ে তো আমায় একেবারেই চেনে না। মণিকা একা হাতে ওদের মানুষ করেছে। আমার লড়াইতে ও যে ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে ধন্যবাদ দিয়ে ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
-ভারতে ফিরতে দেরি হওয়ার জন্য আপনিই তো দায়ী। নিজেই ফিরতে চাননি।
- হ্যাঁ। আসলে তখন পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। অনেক সতীর্থ জাতির জন্য প্রাণ দিচ্ছেন। অনেকে দাঁত চেপে লড়াই চালাচ্ছেন। এমন সময় আমি যদি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতাম, তাহলে ওঁদের মনোবল ভেঙে যেত। আরও বিভিন্ন সমস্যা ছিল। বাংলাদেশ সরকারও জানায়, আমি দোষ স্বীকার করে নিলে ওরা সে দেশের জেলে আমায় রেখে দিতে পারবে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলির কর্মী ও আইনজীবীরাও আমায় অনেক সাহায্য করেন। ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরা ১৯৯৮ সালে কারাগারে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা না করে কারা কর্তৃপক্ষকে লিখিত আবেদন জানাই, আমি ভারতের নয়, অসমের নাগরিক। ভারতের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। এখন মনে হয়, ওই পদক্ষেপটাই ভুল ছিল।
-পরেশ বরুয়া জানিয়েছেন, আপনি বাংলাদেশের কারাগারে বন্দি থাকায় সময়ও তিনি আপনাকে দেখেছেন। অথচ আপনি জানিয়েছেন, এত বছর ধরে আপনাদের কোনও কথা হয়নি।
-আসলে আমায় যখন আদালতে হাজিরার জন্য প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হত, তখন দেখতাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পরেশ। আমিও হাত নাড়াতাম। কিন্ত পরে পুলিশ তা বুঝতে পেরে আমায় বড় বাসে পাঠাত, যাতে পরেশ আমায় দেখতে না পারে। পরবর্তীকালে, দাঁতের চিকিৎসার জন্য যখন আমায় শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হত, তখনও একই ভাবে পরেশ আমার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু কথা বলার সুযোগ ছিল না।
-এখন তো আপনাদের পথ পৃথক হয়ে গেল। পরেশ বরুয়াকে শান্তি আলোচনা বা মূল স্রোতে ফেরার জন্য কোনও বার্তা দিতে চান?
দেখুন, গ্রেফতার না হলে পরেশ এখন যেখানে যে অবস্থায় আছে, আমিও তাই থাকতাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে আর পরেশের মতো সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ১৯৯২ সালে আমি এক বার শান্তি আলোচনায় যোগ দেব বলেও, জামিনে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিলাম। সেই কারণে সরকার ও মানুষ সম্ভবত এখনও আমায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। ৩৬ বছরের সংগ্রামে আলফার তরফেও অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে। আমাদের সদস্যদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষের প্রাণ গিয়েছে। তাই আমি এ বার কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে কথা বলে শান্তি আলোচনার মাধ্যমেই অসম-সমস্যার রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সমাধান চাইছি। সংবাদ মাধ্যমে পরেশকে কোনও বার্তা দেওয়া ঠিক হবে না। এতে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। বরং ভারত সরকার অনুমতি দিলে আমি সরাসরি পরেশের সঙ্গে কথা বলতে চাই। মূল স্রোতে ফিরে আসতে হলে পরেশ নিজেই সেই সিদ্ধান্ত নেবে। ও যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy