জল নেমে যেতেই শুরু হয়েছে পুনর্গঠনের কাজ। ছবি: পিটিআই।
বন্যা বিধ্বস্ত কেরলের পুনর্গঠনে বিদেশি সাহায্য কি আদৌ নেওয়া উচিত? প্রশ্নটা জোরালো হচ্ছে, কেন্দ্রের সাম্প্রতিক ভূমিকা এবং কেরলের পিনারাই বিজয়ন সরকারের পাল্টা আঘাতে।
কেরল সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, বিধ্বস্ত রাজ্যের পুনর্গঠনে প্রায় ২৬০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। এখনও পর্যন্ত কেন্দ্র ৬০০ কোটি টাকা দেবে বলে ঘোষণা করেছে। বিভিন্ন রাজ্য সরকার, অসরকারি ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিগত সাহায্য মিলিয়ে আরও কিছু টাকা সাহায্য মিলবে। কিন্তু, তার পরেও কেরল পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো বেশ কিছু দেশ আর্থিক সাহায্য করবে বলে জানিয়েছিল। সেই পরিমাণটাও কম নয়। কিন্তু বুধবার রাতে কেন্দ্র জানিয়েছে, ‘কেরলের শোচনীয় বন্যার পরে বিভিন্ন দেশ যে ভাবে ভারতকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের নীতি অনুসারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে ত্রাণ ও পুনর্গঠনের ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করি।’
কী বলছে কেন্দ্রীয় নীতি...
বন্যা বিধ্বস্ত কেরলের পুনর্গঠনে তবে কি বিদেশি সাহায্য নেওয়া যাবে না? সরাসরি কোনও জবাব না দিলেও কেন্দ্র জানিয়েছে, ‘বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়রা যদি কেরলের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান, দাঁড়াতেই পারেন। কোনও ভারতীয় সংগঠন যদি সাহায্য করতে চায়, করতে পারে। বিদেশি অনুদান সংক্রান্ত ছাড়পত্র রয়েছে, এমন কোনও ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও সাহায্য করা যেতে পারে।’ অর্থাৎ সরাসরি কোনও দেশের সাহায্য সরকার নেবে না। পাশাপাশি জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সরাসরি আর্থিক সাহায্য করা যেতেই পারে। সে ক্ষেত্রে দরজা খোলা রয়েছে।
আরও পড়ুন
জানেন কি, ‘পাক্কা মুসলমান’ বলে পতাকা ছেঁড়া সেই কিশোর আসলে হিন্দু!
কিন্তু বরাবরই কি এমনটাই হয়ে এসেছে? ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে কখনই বিদেশি কোনও সাহায্যই নেওয়া হয়নি?
প্রাক্তন বিদেশ সচিব ললিত মানসিংহ যেমন মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রায় ১৫ বছর আগেই ভারত এমন সাহায্য নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রে তখন ক্ষমতায় মনমোহন সিংহের প্রথম ইউপিএ সরকার। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের ভয়াবহ সুনামি। দেশের একটা বড় অংশ স্রেফ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মনমোহন সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ত্রাণ এবং পুনর্গঠনের কাজে কোনও বিদেশি সাহায্য নেওয়া হবে না। ব্যস, তার পর আর কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সরাসরি বিদেশি সাহায্য নেওয়া হয়নি। অথচ তার আগে ১৯৯১-এ উত্তরকাশীতে ভূমিকম্প, ওই বছরেই লাতুরে ভূমিকম্প, ২০০১-এ গুজরাতের ভুজে ভূমিকম্প, ২০০২-এ পশ্চিমবঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, ২০০৪-এ বিহারে ভয়াবহ বন্যা— সব ক্ষেত্রেই বিদেশি সাহায্য এসেছে। ভারত তা সাগ্রহে ব্যবহারও করেছে। কিন্তু, ২০০৪-এর পর আর সে ভাবে বিদেশি সাহায্য নেওয়া হয়নি।
বিধ্বস্ত কেরল... ছবি: পিটিআই।
বিদেশি সাহায্য না নেওয়ার ব্যাপারে বড় রাজনৈতিক দলগুলি সম্পূর্ণ ভাবেই এক মত। আর সে জন্যই ২০০৪ সালের মনমোহনের সে নীতিকে ২০১৪-য় ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ সরকারও গ্রহণ করে। ২০১৬ সালে নতুন করে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা নীতি’ তৈরি করা হয়। সেখানে ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রসঙ্গ রয়েছে। তার দু’নম্বর অধ্যায়ে স্পষ্ট ভাবে বলা রয়েছে, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে বিদেশি সহায়তার জন্য নীতিগত ভাবে কোনও আবেদন জানাবে না ভারত সরকার। তবে, কোনও বিদেশি রাষ্ট্র যদি আন্তরিক ভাবে দুর্যোগ আক্রান্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে ইচ্ছাপ্রকাশ করে, তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার তা গ্রহণ করতেও পারে। সে ক্ষেত্রে বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে সমন্বয় বজায় রেখে কাজ করতে হবে। কারণ, প্রাথমিক ভাবে বিদেশি সহায়তার ওই প্রস্তাব খতিয়ে দেখার অধিকার রয়েছে একমাত্র বিদেশ মন্ত্রকেরই। এবং ওই সাহায্য কী ভাবে ব্যবহত হবে, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ারও দায়িত্ব বিদেশ মন্ত্রকের। এর পর সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে কাজ শুরু করতে পারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।’ মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন এই নীতিকেই হাতিয়ার করতে চেয়েছেন।
কিন্তু সরাসরি কোনও বিদেশি সাহায্য নিতে চাইছে না কেন সরকার? প্রাক্তন বিদেশ সচিব কানওয়াল সিব্বলের মতে, বিদেশি আর্থিক সাহায্য নিলে আন্তর্জাতিক ভাবে ভারতের মুখ কোথাও একটা অনুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। যে ভারত এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রথম সারিতে রয়েছে। যে ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জে স্থায়ী সদস্যপদ পেতে ভীষণ ভাবে চেষ্টা করছে। সেই ভারত যদি তার এক বা একাধিক অঙ্গরাজ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর ত্রাণ এবং পুনর্গঠনের কাজ করতে ব্যর্থ হয়, সে জন্য যদি বিদেশি সাহায্য নিতে হয়, তবে দেশের ভাবমূর্তি কোথাও ফিকে হয়ে যায়। আর্থিক ভাবে সবল দেশগুলি তো এমন সাহায্য নেয় না। তাই ভারতও চায় না, এমন বিদেশি সাহায্য সরাসরি নেওয়া হোক।
আরও পড়ুন
মন্দির-শুদ্ধিতে সত্যের সঙ্গী ফৈয়জ, ডেভিসরা
সংযুক্ত আরব আমিরশাহির তরফে কেরলের পুনর্গঠনে ৭০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুবাইয়ের শাসক শেখ মহম্মদ বিন রশিদ। কিন্তু, সেই প্রস্তাবে সরাসরি সাড়া দেয়নি নয়াদিল্লি। বরং সর্বজনীন এক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছে, নীতি অনুসারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে ত্রাণ ও পুনর্গঠনের ব্যবস্থা ভারত নিজেই করে নেবে। অর্থাৎ এক প্রকার ওই ৭০০ কোটির প্রস্তাব নাকচই করে দেওয়া হল। তাইল্যান্ডও কেরলে অর্থ সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতে নিযুক্ত সে দেশের রাষ্ট্রদূত সি স্যাম গঙ্গসকডি টুইট করে জানিয়েছেন, বেসরকারি ভাবে তাঁকে জানানো হয়েছে কোনও দেশেরই আর্থিক সাহায্য নেওয়া হচ্ছে না। এমন ভাবেই ‘না’ হয়ে গিয়েছে কাতার বা মলদ্বীপের সাহায্য প্রস্তাবও।
এই সব সাহায্যের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও দৃঢ় করতে চেয়েছিল কোনও কোনও দেশ। সে সম্ভাবনায় কি জল ঢালা হয়ে গেল? বিদেশ মন্ত্রক যদিও তেমনটা মনে করছে না।
তবে, এই ‘নাকচ’ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে মোদীর সরকার। কেরলে যে হেতু বাম সরকার, তাই কি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার চাইছে না বিদেশি সাহায্য আসুক? আগামী বছরই লোকসভা নির্বাচন। মোদী সরকার যদি রাজ্যের পুনর্গঠনে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করে, তা হলে আগামী নির্বাচনে সেই সুফল পাবে বিজেপি-ই। বিদেশি সাহায্য নিলে মোদী সরকার সেই সুযোগ পাবে না। এই সমালোচনা কড়া হাতেই সামলাতে চাইছে বিজেপি। তাদের যুক্তি, এর সঙ্গে বিজেপি বা ভোট রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এটা তো কেন্দ্রীয় নীতি। মনমোহনের ইউপিএ আমল থেকেই এমনটা চলে আসছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy