আশিস নন্দী। —ফাইল চিত্র।
গণপ্রহারে মৃত্যুর রাজধানী ভারত। আমেরিকায় চালু হয়ে এখন এ দেশেও জাঁকিয়ে বসেছে—কলকাতায় এসে সম্প্রতি তাঁর এক বক্তৃতায় জানালেন সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী। জানালেন, বিশ শতক আর তার আগের যুগের হিংসার স্বরূপ আলাদা। সাবেক মানবিকতা, প্রগতি, সংস্কার ইত্যাদির ছাঁচে এখনকার হিংসাকে ধরা যাবে না। গোরক্ষক, কাশ্মীর, উন্নয়নের রাজনীতি সব কিছুকে তিনি এ বারের ‘সমর সেন স্মারক’ বক্তৃতায় দেখালেন অন্য দৃষ্টিতে।
সেই অন্য দৃষ্টি বোঝাল, হিংসা কী ভাবে বৈধতা পেয়েছে আজকের সমাজে। নাৎসিরা অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে সভ্যভব্য, পারিবারিক। কিন্তু তাঁরা তৎকালীন ইউজেনিক্স বা সুপ্রজননবিদ্যার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভাবতেন ইহুদি, জিপসি বা সমকামীরা অবমানব। ইউরোপ যে ভাবে বলত, আমেরিকা বা আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরা পুরো মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। তারা মানুষ আর না-মানুষের মাঝামাঝি। যুক্তিবাদ মানুষের আবেগ-সত্তা আর বিচারবোধের সত্তাকে প্রায় তেল আর জলের মতো আলাদা করে দেয়। ডাক্তার যেমন আবেগ-সত্তায় ভাসবেন না, বিচার-সত্তা নিয়ে রোগীর ‘অশুদ্ধতার কারণ’টি শরীর থেকে বের করে দেবেন। অস্ত্রোপচার চালিয়ে অশুদ্ধতাকে ছেঁটে দাও, এটাই বিজ্ঞানের যুক্তি। গোরক্ষকেরাও কি প্রগতির এই বয়ানের সন্তান নন?
বিজ্ঞান আরও দেখাল, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানাই সব নয়। কয়েক হাজার ফুট ওপর থেকে বোমাবর্ষণে একটা শহরকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। ওপর থেকে সুইচ টিপে বৈমানিক যখন বোমা ফেলছেন, দূরত্বের কারণেই নীচের মানুষগুলিকে তিনি দেখতে পান না। পেন্টাগনে বসে বোতাম টিপে আফগানিস্তান, ইরাককে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। জলজ্যান্ত, রক্তমাংসের মানুষকে দেখা হয় আবছা অবয়বপুঞ্জ হিসেবে। সেগুলি সংখ্যায় মাপা যায়। তাই তথাকথিত উন্নয়নের ফ্রেমওয়ার্কে থাকার যোগ্যতা যার নেই, তাকে অক্লেশে বাতিল করে দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন: সঙ্ঘকে ধরে দিল্লির কাছে পৌঁছতে চাইছেন খালেদা
আশিস জানালেন, এটিও হিংসার আর একটি কারণ। ‘যুদ্ধ আর দাঙ্গার থেকেও উন্নয়নে উৎখাত হয়েছেন আরও বেশি মানুষ,’ বলছিলেন ‘দ্য ইন্টিমেট এনিমি’-র লেখক। ইংল্যান্ডে খুনোখুনি নিয়ে জর্জ অরওয়েলের পুরনো একটি লেখাও টানলেন আশিসবাবু। অরওয়েল সেখানে লিখছেন, আগে ইংল্যান্ডে খুন ছিল অন্য রকম। হয়তো লাইব্রেরির চেয়ারে দেহ পড়ে আছে, পুলিশ এসে খুনের কারণ খুঁজছে। কিন্তু অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে তিন-চার জনকে হলিউডি স্টাইলে অক্লেশে খুন করা মার্কিন ‘মাস কালচারে’র প্রভাব। গোরক্ষক থেকে আইএস জঙ্গি সবাই কেন নিজেদের কীর্তি ইউটিউবে পোস্ট করে, সেটিই যেন অরওযেলের মাধ্যমে জানিয়ে গেলেন সমাজবিজ্ঞানী।
সভা জমে গেল অন্য জায়গায়। আশিসবাবু বলছিলেন, উন্নয়ন শব্দটাই তাঁর অপছন্দের। স্বাভাবিক ভাবেই সভামুখ্য, অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন এ ব্যাপারে একমত হলেন না। উন্নয়নের জন্যই আদিবাসীদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার কমছে, মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ছে, বললেন তিনি। বিশেষ অতিথি, ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী আবার তাঁর সঙ্গে একমত হলেন না। ‘কল্যাণকামী রাষ্ট্র, ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স আর ক’দিনের ব্যাপার? মানুষ যে কত হিংস্র, তা বলতে পারত মেরুভল্লুক বা অন্য কোনও প্রজাতি,’ বললেন দীপেশ। কে জানত, হিংস্রতার অন্য নাম মানবতা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy