ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের সেই বাড়ির দেওয়ালে রক্তের দাগ এখনও মোছেনি। ক’দিন আগেও ঢাকায় গিয়ে দেখেছি সেই বিষাদ-স্মৃতি। পদ্মায় এর পর অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আজও এ শহরে ঘাতকের হাতে নিহত হয়ে চলেছেন অভিজিৎ রায়, অনন্তবিজয় দাস, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়রা। ব্লগ লেখকদের রক্তের দাগও একই ভাবে অমলিন।
এই সেই ১৫ অগস্ট। ’৪৭ সালের দেশভাগের স্বাধীনতা। আর একটি ’৭৫ সালের ১৫ অগস্ট শেখ মুজিবের হত্যার দিন। দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সইদ মুয়াজ্জম আলি বলছিলেন, ‘‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের ওই সময়টায় আমি ওয়াশিংটনে অবিভক্ত পাকিস্তানের দূতাবাসে কর্মরত। প্রতিবাদে একযোগে আমরা বহু কূটনীতিক ইস্তফা দিয়েছিলাম। তার কারণ, আমরা এক স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলাম। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই আজও থামেনি।’’ সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশ এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু মৌলবাদী ঘাতকবাহিনী আজও সক্রিয়। তারা আজও চাইছে এই ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে পরাস্ত করে উন্নয়নের রাস্তাকে কণ্টকাকীর্ণ করতে।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সফরসঙ্গী করে ঢাকা গিয়ে স্থলসীমান্ত চুক্তি করেছেন। শেখ মুজিবের স্বপ্ন সফল হয়েছে। আয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মুজিব লড়াই করেছিলেন। বাঙালির স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন তিনি। ছ’দফা দাবি তুলেছিলেন। যার নাম হয়েছিল বাঁচার দাবিসনদ। সে দিন পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন আয়ুব খান। শেষ পর্যন্ত আয়ুবকে আলোচনার টেবিলে বসতেও বাধ্য করেন মুজিব। সৈয়দ মুজতবা আলির ভাইপো দিল্লিস্থিত বাংলাদেশের বর্তমান হাইকমিশনার সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, আমার চাচা বাংলা থেকে কাবুল পর্যন্ত রেলপথে যাত্রা করেছিলেন। এখন আমরা সেই রেল যোগাযোগকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলছি। যে রেলপথ এক দিন ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদের শক্তি সেই রেলপথকে টুকরো করেছে। কূটনীতিক রণেন সেন বলেন, ‘‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জঙ্গি শক্তিকে রুখতে সচেষ্ট হয়েছেন। বাংলাদেশের জমিকে সন্ত্রাসবাদের জন্য ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না। গোটা পৃথিবী আজ এই সন্ত্রাসের হাতে পীড়িত। সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সরকার গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। ভারতের স্বাধীনতা দিবস তাই শুধু ভারতের স্বাধীনতা নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে বোঝাপড়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের দিনও বটে।
১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিনটিকেই মুজিবের হত্যার দিন হিসাবে ঘাতকেরা কেন বেছে নিয়েছিল তা নিয়েও ঐতিহাসিক-কূটনীতিকদের মধ্যে বহু গবেষণা রয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রাক্তন ভারতীয় হাইকমিশনার রাজীব মিটার বলেন, বাংলাদেশের ’৭১ সালের স্বাধীনতার লড়াইতে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ইন্দিরা গাঁধী এই রাষ্ট্র গঠনকে সমর্থন করেছিলেন। আর সেই কারণেই মৌলবাদী শক্তি সম্ভবত ১৫ অগস্টকে এই হত্যার দিন হিসাবে বেছে নিয়েছিল। এর মধ্যে একটা বদলার মানসিকতা লুক্কায়িত ছিল।’’ ’৭১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে বাংলাদেশ গঠন নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যুক্তিকে সমর্থন করে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহানুভূতি থাকলেও প্রকাশ্যে আমেরিকার বিরোধিতা থেকে তারা বিরত ছিল।
নানা সূত্রে খবর আসছে, বাংলাদেশের জমিকে ব্যবহার করে আবার জামাতের জঙ্গিগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠতে চাইছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, ‘‘এই শক্তির তৎপরতা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। এক দিকে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করার বিষয়ে প্রকাশ্য মতামত জানিয়েছে। আবার অন্য দিকে একের পর এক স্বাধীনচেতা ব্লগারকে হত্যা করে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। এই সন্ত্রাসের শক্তিকে আমাদের সমবেত ভাবে মোকাবিলা করতে হবে।’’
আসলে ব্লগার ঘাতক বলে কিছু হয় না। শেখ মুজিব থেকে আজকের ব্লগার হত্যা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির উপর আঘাত হানার চেষ্টা বলেই মনে করছেন দু’দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy