Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Delhi

চলবে জান কবুল লড়াই, অনড় গাজিপুর

ট্র্যাক্টরের খোঁদলে, রাস্তায় চট পেতে, খড়ের বিছানা করে, তাঁবু খাটিয়ে, দিল্লির সীমানায় একশো দিন কাটিয়ে দেওয়া আন্দোলনরত কৃষকদের জেদ এবং ধৈর্য যেন দিন দিন বাড়ছে। চোয়াল আরও শক্ত হচ্ছে ক্রমশ।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
গাজিপুর শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২১ ০৮:১২
Share: Save:

একশো দিনের মধ্যে বারবার ঋতুবদল ঘটেছে দিল্লির চরমপন্থী আবহাওয়ায়। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা, কিছুটা বৃষ্টির পরে এখন উষ্ণতার পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। সামনে অপেক্ষায় খাঁ খাঁ গ্রীষ্ম। কিন্তু খোলা আকাশের নীচ থেকে ‘ঘর ওয়াপসি’ করবেন না বলে শপথ নিয়েছেন কৃষকেরা। ট্র্যাক্টরের খোঁদলে, রাস্তায় চট পেতে, খড়ের বিছানা করে, তাঁবু খাটিয়ে, দিল্লির সীমানায় একশো দিন কাটিয়ে দেওয়া আন্দোলনরত কৃষকদের জেদ এবং ধৈর্য যেন দিন দিন বাড়ছে। চোয়াল আরও শক্ত হচ্ছে ক্রমশ।

গাজিপুরে আন্দোলনস্থলের দু’কিলোমিটার আগেই রাস্তা জুড়ে ব্যারিকেড। দিল্লির দিক থেকে পৌঁছনোর জন্য ২৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে বিস্তীর্ণ ঝোপের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা রাস্তা। সকাল থেকেই যেখানে লঙ্গর চালু দফায় দফায়। একশো দিনে যেন অনেকটাই পরিণত হয়েছে আন্দোলন। একটু কি বদলেছেও? কারণ এখন শুধু সীমানায় স্লোগান, বক্তৃতা আর গর্জনেই সীমাবদ্ধ থাকছে না আন্দোলনের ভাবনা। মাছি ভনভন তেপায়াতে বসা গাজিয়াবাদের কিসান ইউনিয়নের জেলা অধ্যক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হুঁকোর নল বাড়িয়ে দিলেন। প্রশ্ন করলাম গাজিপুরের আন্দোলন নিয়ে। উত্তর এল, ‘‘গোটা দেশেই তো ছোট ছোট করে আন্দোলন হচ্ছে, মিটিং হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, বাংলা, তেলঙ্গানা— সর্বত্র যাব। পূর্বাঞ্চল থেকে এই সব জায়গায় যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়েছেন ইতিমধ্যে। এখন আর শুধু দিল্লি সীমানায় নয়, গ্রামে গ্রামে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। কিসান মজদুর জনজাগরণ চলছে।’’ তাঁর কথার রেশ টেনেই বললেন মেরঠ থেকে আসা কৃষক নেতা জিল্লে সিংহ, ‘‘যে যাঁর গ্রামে মানুষকে সচেতন করছেন। বলা হচ্ছে, যেখানে যখন ভোট আসবে, মোদীর বিরুদ্ধে যেন ভোট দেওয়া হয়।’’

ছোট ছোট হুঁকোর এই আড্ডাগুলিতে ফিসফাস গল্পও চলছে বিশ্বাসঘাতকতার। অনেকেই নাকি শাসক বিজেপির কাছ থেকে টাকা নিয়ে আন্দোলনের বদনাম করার চেষ্টা করছে। চলছে অন্তর্ঘাতের চেষ্টাও। ‘‘অথচ ফসল কাটার সময় আমরা চাষের খেত ফেলে মাসের পর মাস রাস্তায় বসে আছি। আর আমাদের সরকার বলছে পাকিস্তানি, সন্ত্রাসবাদী! খোঁজ নিয়ে দেখুন শুধু উত্তরপ্রদেশেই সরকারের ঘরে চাষিদের পনেরো হাজার কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। দু’বছর ধরে আমাদের বকেয়া টাকা দেওয়া হচ্ছে না’’, ক্ষোভ স্পষ্ট বালিয়ার বৃদ্ধ কৃষক ওমপ্রকাশ গুপ্ত-র গলায়।

রাস্তার উপর তৈরি হওয়া এই জনপদে ছোট ছোট নিত্যপ্রয়োজনীয় মেক শিফট বিপণির পাশাপাশি হাজির ক্ষৌরকারেরাও। মাটিতেই প্লাস্টিক উল্টে বসে চলছে দাড়ি কাটা। মুজফ্‌ফরনগরের ফুগানা তহসিলের প্রধান রাজবীর সিংহ পেহলওয়ানকে পাওয়া গেল সেখানেই। কোনও রাখঢাক না রেখে গলা তুলে বললেন, ‘‘পারলে ভিডিয়ো করে নিন! আমরা ভুল করে চোরকে চৌকিদার করেছি! এই সরকার বেইমান।’’

এখানে কৃষকদের সম্মিলিত সুর, তাঁরা নিজেরা কোনও রাজনৈতিক দলের ছাতার নীচে আসবেন না। তাঁদের নিয়ে কোনও রাজনীতি হোক, এটাও তাঁদের না-পসন্দ। কিন্তু সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করার জন্য ‘জনজাগরণ’ তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন। আন্দোলনের গোড়া থেকেই দিল্লি সীমানায় রয়েছেন সিপিএমের কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘১২ মার্চ কলকাতায় কৃষক সংগঠনগুলির সভা হবে। যে হেতু বিজেপি তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করছে না, তাই আমরা সেখানে বিজেপি-কে সরানোর ডাক দেব। কিন্তু কোনও দলের হয়ে ওখানে প্রচার করা হবে না। তৃণমূল বা সিপিএম— আমরা কোনও দলের হয়েই প্রচার করব না।’’

কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলেও বিভিন্ন রকমের সমর্থন কিন্তু ভিড় জমাচ্ছে গাজিপুরে, যা দু’মাস আগেও এখানে এসে দেখা যায়নি। যেমন ভোপাল থেকে এসেছেন হিন্দি ‘ইউটিউবার’ বীরেন্দ্র কুমার উপাধ্যায়। ইনি পেশায় কৃষক নন, কিন্তু আন্দোলনকারী। অক্লান্ত ভাবে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে চাষিরা এখন যা বলছেন, তাতে কিন্তু তিনটি কৃষি আইন, এমএসপি, মজুতদারদের কথার পাশাপাশি, উঠে আসছে মোদী সরকারের ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে শানিত বিদ্রুপ, লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার বিবরণ, তালি বাজানো নিয়ে ব্যঙ্গও।

‘‘সংসদের থেকে অনেক বড় হল সড়ক। সব সমস্যার সমাধান সড়কে হয়। আজ বিজেপি ৩০৩ সংখ্যার গর্বে কৃষকদের অশ্রদ্ধা করছে। ওরা ভুলে গিয়েছে, রাজীব গাঁধীর কংগ্রেসের কিন্তু আরও বেশি সংখ্যা ছিল এক সময়। সময় এবং রাজনীতি কোথায় কাকে কোথায় নামিয়ে আনে, কেউ বলতে পারে না,’’ বলছেন শ্যাম কিশোর যাদব। বিহারের কিসান মহাসভার নেতা। চলে এসেছেন গাজিপুরে।

একশো দিনে পৌঁছে গাজিপুরের আশা, কেরল, বাংলা, তামিলনাড়ু প্রথমে যোগ না দিলেও ধীরে ধীরে সেখানেও ‘চেতনা’ তৈরি হচ্ছে। শুধু দিল্লির সীমানা নয়, অদূর ভবিষ্যতে মোদী সরকারকে ঘিরে ফেলবে দেশের গ্রাম, মাটি, শস্য বাঁচানোর এই লড়াই।

তত দিন, জান কবুল আর মান কবুল!

অন্য বিষয়গুলি:

Farmers Delhi Gazipur Farmers Protest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy