বিচারবিভাগের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে মতভেদ নতুন কথা নয়। ভারতীয় গণতন্ত্রে বিভিন্ন জরুরি মামলায় দেখা গিয়েছে নিম্ন আদালতের রায় কী ভাবে উচ্চ আদালতে গিয়ে পাল্টে যায়। তা সত্ত্বেও এ বার মথুরার কৃষ্ণ জন্মভূমি বনাম শাহি ইদগা মসজিদ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে ভাবে স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দিল, তা থেকে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়। যে মূলগত আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই নির্দেশ, ইলাহাবাদ হাই কোর্টে তা কেন গ্রহণযোগ্য হল না? মথুরার শাহি ইদগা মসজিদের নীচে মন্দির-সন্দেহে সমীক্ষায় হাই কোর্ট সদর্থক রায় দিয়েছিল, বিচারবিভাগীয় কমিশনারের অধীনে সেই সমীক্ষা করার শর্তে আবেদনে সম্মতি জানিয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশটি আসে। চলমান সপ্তাহে সেই স্থগিতাদেশেরই পক্ষে মত প্রকাশ করে সর্বোচ্চ আদালতের বক্তব্য, ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী উপাসনাস্থলের ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তনে নিষেধ আছে। হিন্দুদের কাছে ওই স্থানের যতই গুরুত্ব থাকুক, বর্তমান মসজিদের চরিত্র পরিবর্তন করায় আইনি সিলমোহর দেওয়া সম্ভব নয়। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এই আইনে ধরা আছে। বিচারবিভাগের বিবেচনায় তার স্থান পাওয়ার কথা ছিল, যেমন পেয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে।
গত বছর বেশ কিছু ‘হিন্দু পক্ষ’ একত্র ভাবে ১৯৯১ সালের আইনের বিরুদ্ধে আবেদন করে। যুক্তি ছিল, এতে হিন্দুদের উপাসনাস্থল অধিগ্রহণে অসুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে— বিশেষত যেখানে আগে বলপূর্বক উপাসনাস্থলে মসজিদ তৈরি হয়েছিল, সেখানে অতীত আক্রমণকারীদের আক্রমণে এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আইনি সমর্থন পড়ছে। এর উত্তরে জমা পড়ে আইনের সর্মথনে আরও অনেক আবেদন। সেই পাল্টা আবেদনগুলিতে দেখানো হয়, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের দ্বন্দ্বে এই আইনটি কত গুরুত্বপূর্ণ। ১৫ অগস্ট ১৯৪৭-কে একটি সীমারেখা ধরে নিয়ে ওই আইনে কোনও ধর্মস্থানের চরিত্রবদল নিষিদ্ধ হয়, একমাত্র ব্যতিক্রম থাকে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির ক্ষেত্রটি। আপাতভাবে এর যুক্তি, সেটি অনেক পুরনো বিবাদ। অর্থাৎ অযোধ্যার রামমন্দিরটির মডেলে আরও মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরিতে বাধা তৈরি করে রেখেছিল ১৯৯১ সালের আইন।
উত্তরপ্রদেশের একাধিক মুসলমান সংগঠন ইতিমধ্যে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, এই বিবাদ তাদের প্রত্যহ বিপন্ন করছে। এ এমনই এক সংবেদনশীল বিষয় যে, মীমাংসা হোক না হোক, এর আলোচনা থেকেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ তৈরি হওয়া এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রচার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বাস্তবিক, সম্ভলের ঘটনা তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ। একটি মসজিদ কমিটি সর্বোচ্চ আদালতের কাছে জানিয়েছে যে, আবেদনের উত্তর দিতে হিন্দু পক্ষ থেকে ইচ্ছাপূর্বক বিলম্ব ঘটানো হচ্ছে। স্বভাবতই বিবাদটি যত জিইয়ে রাখা হবে, ততই এর থেকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শক্তি সঞ্চয়ে সুবিধা, মানুষের মধ্যে হিংসা ভাব ছড়ানোর সুবিধা। যোগী আদিত্যনাথ সরকারের অবস্থানটি সহজেই অনুমেয়। যথাসম্ভব বিষয়টিতে ইন্ধন জোগানো চলছে, সম্ভলের শাহি জামা মসজিদের পাশের জমিতে পুলিশ চৌকি বসানো যার অন্যতম উদাহরণ। অশান্তি ঠেকানোর অজুহাতেই অশান্তি তৈরির ভাবনাটিকে যথাসাধ্য ওস্কাচ্ছে বিজেপি ও আরএসএস। সরকারি কর্তারা মুসলমান জমি-মালিকদের ওয়াকফ কাগজপত্র ভুয়ো প্রমাণ করতে প্রচার চালাচ্ছেন। কাগজপত্র ভুয়ো কি না, তার যথাযথ তদন্ত হোক, কিন্তু প্রশাসনিক তদন্তের আগেই যখন প্রশাসনিক প্রচার শুরু হয়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ধর্মীয় রাজনীতির চাপ বাড়ানোই আসল লক্ষ্য, কাগজপত্রের বৈধতা প্রমাণ নেহাতই উপলক্ষ। এই পরিস্থিতিতে বিপন্ন আক্রান্ত সংখ্যালঘুর কাছে আদালতের দরজাই একমাত্র গন্তব্য। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ সেই আশ্বাস দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy