আপের সভা চলাকালীন এই ভাবেই আত্মঘাতী হলেন এক কৃষক। তাঁর দেহ উদ্ধারের চেষ্টা করছেন দলের সমর্থকেরা। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: রয়টার্স।
বিরোধীরা তাঁকে বরাবরই কটাক্ষ করে বলে থাকে— ‘নাটুকে’। সেই অরবিন্দ কেজরীবালকেই নিজের ডাকা ধর্না-মঞ্চ থেকে আজ এক মর্মান্তিক নাটক দেখতে হল। যন্তর-মন্তরে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর চোখের সামনেই আত্মহত্যা করলেন তাঁর দলের সমর্থক এক কৃষক। ধর্না-মঞ্চ থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে একটি নিমগাছে উঠে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয় গজেন্দ্র সিংহ নামে রাজস্থানের ওই কৃষককে।
ভরা সভায় পুলিশের সামনে এই আত্মহত্যার পর শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক চাপান-উতোর। কেন্দ্রের আনা জমি বিলের বিরুদ্ধে আজ ওই ধর্নার ডাক দিয়েছিলেন কেজরীবাল। ঘটনার পর বিজেপি দাবি করেছে, আত্মহত্যার দায় কেজরীবালের। কারণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ওই কৃষককে কোনও আশার আলো দেখাতে পারেননি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। আম আদমি পার্টির অভিযোগ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ গোটা ঘটনায় অদ্ভুত অসংবেদনশীল আচরণের পরিচয় দিয়েছে। আত্মহত্যায় উদ্যত এক ব্যক্তিকে বাধা দেওয়া তো দূর, উদ্ধারকার্যেও এগিয়ে আসেনি তারা। কংগ্রেস দুষেছে আপ-বিজেপি দু’পক্ষকেই। ‘কৃষক-বিরোধী’ জমি নীতির জন্য কেন্দ্রকে আক্রমণের পাশাপাশি কংগ্রেস নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, চোখের সামনে এমন কাণ্ড দেখার পরেও কেন সভা চালিয়ে গেলেন ‘আম আদমি’ কেজরীবাল? কেন রুটিন মেনে নিজের বক্তৃতাটি দিলেন? যদিও আপ নেতাদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী আগাগোড়া মঞ্চে ছিলেন। দলীয় নেতাদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন তিনি। গজেন্দ্রকে নিরস্ত করার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি।
আজ সকাল থেকেই দিল্লির নানা প্রান্ত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এমনকী বিহার থেকেও বাস ভর্তি করে আসা আপ সমর্থকেরা ভিড় জমাতে থাকেন যন্তর-মন্তরে। বেলা দেড়টা নাগাদ এসে পৌঁছন কেজরীবাল। মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েন সমর্থকরা। সভা এগোচ্ছিল নিজের ছন্দে। মঞ্চে তখন বক্তৃতা দিচ্ছেন দলের নেতা কুমার বিশ্বাস। প্রায় সেই সময়েই দেখা যায়, রংচঙে পাগড়ি পরা গজেন্দ্র নিমগাছ বেয়ে উঠছেন। হাতে আপ-এর প্রতীক— একটি ঝাড়ু।
প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, ভাল করে বক্তৃতা শুনবেন বলেই হয়তো গাছে উঠছেন তিনি। এমনকী তাঁর পিছন পিছন গাছে উঠতে শুরু করেন আরও দু-এক জন। তাঁরা কিছুটা উঠে থেমে গেলেও গজেন্দ্রকে দেখা যায় ক্রমশ মগড়ালের দিকে এগিয়ে যেতে। জুতো খুলে ফেলেন তিনি, ঝাড়ুটিকেও রেখে দেন গাছের ডালে। হঠাৎ দেখা যায়, একটা সাদা গামছা গাছের ডালে বেঁধে ফেলেছেন গজেন্দ্র। অন্য প্রান্তটি তিনি হাতে পাকাচ্ছেন। কিছু বলার চেষ্টা করতেও দেখা যায় তাঁকে। প্রমাদ গোনেন কুমার বিশ্বাস। গজেন্দ্রকে নেমে আসার জন্য অনুরোধ জানাতে শুরু করেন তিনি। মঞ্চে কেজরীবালও তত ক্ষণে ব্যাপারটা দেখেছেন। কুমার বিশ্বাসকে বলতে শোনা যায়, গজেন্দ্রর কোনও সমস্যা থাকলে তা মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হবে। মুহূর্তের মধ্যেই দেখা যায়, ঝুলে পড়েছেন গজেন্দ্র।
শোরগোল পড়ে যায় সভায়। গজেন্দ্রকে উদ্ধার করতে গাছে উঠে পড়েন একাধিক আপ সমর্থক। ততক্ষণে ফাঁস লেগে জিভ বেরিয়ে গিয়েছে ওই কৃষকের। ঘণ্টা খানেকের চেষ্টায় গাছ থেকে নামিয়ে গজেন্দ্রকে নিয়ে যাওয়া হয় রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আর কিছু করার নেই। সুইসাইড নোট থেকে জানা যায় গজেন্দ্রর পরিচয়। জানা যায়, তাঁর বাড়ি রাজস্থানের দৌসা জেলায়। তাঁর তিন সন্তান। গজেন্দ্র লিখেছেন, সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাবা তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন।
পুলিশের একাংশের অবশ্য অনুমান, আত্মহত্যার পরিকল্পনা আদৌ ছিল না গজেন্দ্রর। কোনও ভাবে পা পিছলে গিয়েছিল তাঁর। কিন্তু গোটা সময়টায় পুলিশ কেন দর্শকের ভূমিকায় রইল, এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এই ঘটনায় এফআইআর দায়ের করতে গিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনেছে দিল্লি পুলিশ। কারণ, অভিযোগ উঠেছে, আপ সমর্থকদের একাংশই নাকি গজেন্দ্রকে গাছে চড়তে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। আবার গজেন্দ্রকে উদ্ধার করতে প্রাণ হাতে নিয়ে মগডালে ওঠা এক আপ সমর্থকের দাবি, কয়েক জন পুলিশকে দৃষ্টিকটূ ভাবে হাসাহাসি করতে দেখেছিলেন তিনি। কেজরীবাল নিজেও পরে বলেছেন, ‘‘দিল্লি পুলিশ আমাদের অধীনে নয় ঠিকই।
কিন্তু মানবিকতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!’’
অনেকেই মনে করছেন, গজেন্দ্রর আত্মহত্যার ঘটনায় সব চেয়ে বেশি চাপে পড়েছে বিজেপি। মাত্র দু-তিন দিন আগেই রামলীলা ময়দানের সভায় ও সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘কৃষক-বিরোধী’ বলে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন রাহুল গাঁধী। কৃষকেরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলেছিলেন (আজ গজেন্দ্রর খবর নিতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন রাহুলও)। বস্তুত, কৃষক-স্বার্থের প্রশ্ন তুলে বিরোধীরা সকলেই নতুন জমি বিলের বিরুদ্ধে এককাট্টা। এই প্রেক্ষাপটে রাজধানীর বুকে আজ ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ কৃষকের আত্মহত্যা এবং কেন্দ্রের অধীন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। কারও কারও মতে, এই জোড়া অস্বস্তি সামাল দিতেই এক দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ তড়িঘড়ি ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য দিকে, গজেন্দ্রকে দেখতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডা সোজা হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছেন। আর গজেন্দ্রর মৃত্যুসংবাদ আসার পর খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটারে লিখেছেন, ‘‘গজেন্দ্রর মৃত্যুতে দেশ ব্যথিত। ওঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাই।’’
এই প্রসঙ্গেই বিরোধীদের একাংশ বলছেন, ২০১৪ সালে সারা দেশে ১১০৯ কৃষক আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু কারও নাম করে প্রধানমন্ত্রীকে শোকবার্তা দিতে দেখা যায়নি। তাঁদের মতে, খাস দিল্লির বুকে এ ভাবে এক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে পেরেই এখন মুখ খুলতে হয়েছে মোদীকে। বিজেপির এক নেতাও বলেছেন, ‘‘কৃষকের বদলে এক জন শ্রমিক বা ছুতোর আত্মহত্যা করলে বিজেপির বোধ হয় এত সমস্যা হত না।’’ ক’দিন আগেই মোদী বলেছিলেন, বৃষ্টিতে যে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে, সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়াবে। গজেন্দ্র সুইসাইড নোটে একই সমস্যার কথাই লিখেছেন। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, মোদীর বার্তা কি আদৌ পৌঁছেছিল তাঁর মতো কৃষকদের কাছে, বিশেষ করে রাজস্থানে যখন বিজেপিরই সরকার?
ফলে বিজেপি নেতারা বুঝতে পারছেন, আজকের ঘটনা জমি অধিগ্রহণ-সহ একাধিক বিতর্কে ঘৃতাহুতি দেবে। কৃষকের আত্মহত্যাকে হাতিয়ার করে সংসদের চলতি অধিবেশনে একযোগে সরব হবে বিরোধী শিবির। বস্তুত, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আজ রাহুলও বলেন, ‘‘কেন্দ্রের কৃষক-বিরোধী নীতিই এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী। পুঁজিপতিদের হাতে তামাক খেয়ে সরকার কৃষকদের হাত ছেড়ে দিয়েছে।’’ অনেকের মতে, সম্ভবত ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আঁচ করেই আজ আরও একটি টুইট করেন মোদী। লেখেন, ‘‘খেটে খাওয়া কৃষকেরা যেন কোনও অবস্থাতেই নিজেদের একা না ভাবেন। আমরা কৃষকদের জন্য আরও ভাল দিন আনব।’’
অন্য দিকে আপ নেতৃত্বও বুঝেছেন, অস্বস্তিতে পড়েছেন তাঁরাও। রাহুল এই ঘটনার জন্য নৈতিক ভাবে মোদী সরকারকে দায়ী করেছেন ঠিকই। কিন্তু দলীয় তরফে কংগ্রেস দাবি করেছে, গজেন্দ্রর আত্মহত্যার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য— দুই সরকারের প্রধানের বিরুদ্ধেই মামলা হওয়া উচিত। এই প্রসঙ্গেই কেজরীবালের বিরুদ্ধে ‘অসংবেদনশীলতা’র অভিযোগ তুলেছে তারা। প্রশ্ন তুলেছে, কেজরীবাল কেন গজেন্দ্রকে বাধা দিলেন না? মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা দায়ের করার দাবি তুলেছে তারা। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে আপ নেতা আশুতোষ সাংবাদিক সম্মেলনে কটাক্ষের সুরে বলেন, ‘‘কেজরীবালের তো গাছে উঠে ওঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত ছিল! কিন্তু তিনি সেটা করেননি।’’ এই মন্তব্যে আবার এক প্রস্ত বিতর্ক তৈরি হয়। শেষে টুইট করে ক্ষমা চান আশুতোষ।
ঘনিষ্ঠ মহলে আপের এক নেতার আক্ষেপ, কেন্দ্র-বিরোধী ধর্নায় নেমে তাঁরা কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন, যাতে গো-বলয়ে কৃষক শিবিরের মধ্যে আপের প্রভাব বৃদ্ধি হয়। কিন্তু এখন হিতে বিপরীত হল। নেতাটির কথায়, ‘‘ধর্নাস্থলে দলীয় সমর্থকের আত্মহত্যার ঘটনায় এখন এই বার্তা যাচ্ছে যে, দল কৃষকদের মধ্যে কোনও আশার সঞ্চার করতে পারেনি। তাই ওই আত্মহত্যার ঘটনা।’’ বস্তুত, বিজেপি ঠিক এই যুক্তি তুলে ধরেই গজেন্দ্রর আত্মহত্যার নৈতিক দায় চাপিয়ে দিয়েছে আপের ঘাড়ে। ওই কৃষকের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে আগামিকাল সকালে দিল্লিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে তাদের। সেই সঙ্গে বিজেপি নেতারা বলছেন, ২০১২ ও ২০১৩ সালে কয়েক হাজার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আত্মঘাতী হয়েছিলেন। ফলে কৃষকদের দুর্দশার দায় এড়াতে পারে না ইউপিএ সরকারও।
দিনের শেষে অনেকেই মনে করছেন, আজকের নাটকের যবনিকা মোটেই পড়েনি। বরং নাটকের এই সবে শুরু। আরও সুর চড়বে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের।
কেন্দ্রে শুধু রয়ে যাবে একটি আত্মহত্যা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy