বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
বাংলাদেশের ব্যাপার সম্পর্কে বলি, এটা যে হঠাৎ হয়ে গিয়েছিলো, তা নয়। এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত ও একেবারে তক্ষুনি তক্ষুনি নেওয়া হয়নি। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, আমরা... মানে নিজেদের সমস্যাতেই তো আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলুম, তার আগে১৯৬৯ সালে কংগ্রেস দলের মধ্যে নানান ঝঞ্ঝাট গিয়েছে, তারপর ছিল নির্বাচন, এবং এই রকমের আরোও সব ব্যাপার... তা আমরা জানতাম যে, বাংলাদেশ এ একটা কিছু ঘটছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, অবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে পরে আমরা সচেতন হই. কি যে করবো, সে বিষয়ে মনস্থির করা যাচ্ছিল না, এদিকে শরণার্থীদের স্রোত এসে ঢুকে পরছিল আমাদের দেশে, অথচ এও আমাদের মনে হচ্ছিল যে, অন্য দেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা আমাদের উচিত হবে না। কিন্তু কিছু একটা যে আমরা করতে পারি, করা উচিত, সেটাও আমরা বুঝতে পারছিলুম। সেই কারণেই তখন আমি বিশ্ব সফরে যাই। কেননা আমার তখন মনে হচ্ছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড এবং অন্য কিছু দেশে হয়ত পাকিস্তানের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে; হয়তো তারা বুঝতে পারে যে, বাংলাদেশের অবস্থাটা ঠিক কি। এত মামুলি একটা ব্যাপার নয়, একটা বিরাট একটা অসন্তোষ, অনেকদিন আগে থেকেই যা কিনা মর্মের একেবারে গভীরে তার শিকড় চালিয়েছে।
১৯৬১ সালের একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেবারে একটা লেকচার ট্যুর ছিল। প্রধানত নানা কলেজে আমি বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি। লক্ষ্য করেছিলুম যে, যেখানেই যাই, কিছু পাকিস্তানি আমাকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করে। কাজটা কখনো ও তারা নিজেরা করে, কখনো ও বা মার্কিনদের দিয়ে করায়। দেখতেই পাচ্ছিলুম যে, কাশ্মীর গোয়া কিংবা কৃষ্ণ মেনন কে নিয়ে প্রশ্ন করবার জন্য তারা মার্কিন শ্রোতাদের তাতিয়ে তোলবার চেষ্টা করছে। এই তিনটিই ছিল তাদের প্রশ্নের প্রধান বিষয়। কিন্তু বক্তৃতার পরে থাকতো চায়ের বিরতি। অনেক ক্ষেত্রেই তখন পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা আমার কাছে আসতেন। আমি যে অল্প অল্প বাংলা জানি, সে কথা জানতেন বলে আমার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন তারা। বলতেন, ‘‘আপনি আমাদের দিদির মতো। অথচ এক দেশের মানুষ হওয়া সত্বেও এরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। এইযে দূর দেশে এসেছি আমাদের সঙ্গে এরা বৈষম্যমূলক আচরন করে। ওদের ধারণা, মানুষ হিসেবে ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বড়। আমাদের দিয়ে ওরা আজে বাজে কাজ করিয়ে নেয়।’’ পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা তখনই আমাকে বলেছিলেন যে, ওদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা যত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা তা পায় না। আমাদের ন’টি শহর পাকিস্তানে বোমায় বিধ্বস্ত হওয়ার পরই আমরা বাংলাদেশে ঢুকেছিলুম। কিন্তু তার আগেই এখানে একটা প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়ে; বলা হচ্ছিল যে, একটা কিছু আমাদের করা দরকার। তা আমরা যথাসাধ্য করেছিলুম। শরণার্থীদের যতটা যত্ন নেওয়া যায়, নিয়েছিলুম। সেও একটা বিরাট কাজ।
প্রিন্সেপঘাটে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
ইউরোপের কিছু মানুষ আমাকে বলেছিলেন যে, মহাযুদ্ধের পরে অল্প কিছু শরণার্থীর দেখা শোনার ব্যবস্থা করতেই তাদের বছরের পর বছর এতে গেছে। আর সে ক্ষেত্রে আমরা নিয়েছিলুম এক কোটি শরণার্থীর দেখাশোনার দায়িত্ব। তাহলেই বুঝতে পারছেন যে, একমাত্র তখনই আমাদের অস্ত্র ধারণ করতে হয়েছিল। অথচ পাশ্চাত্য দেশগুলোতে যেসব বিশ্বকোষ ছাপা হয়, সেগুলি করে দেখুন, দেখবেন যে, ১৯৬৫ আর১৯৭১ ভারত বর্ষ পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছিল বলে তাতে লেখা আছে। ওরা আরো বলে যে, আমরা যে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল, সেটা চাপে পড়ে। কিনা আমাদের উপরে চাপ দেওয়া হয়েছিল। ভারতবর্ষে একথা কেউ একথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু বিদেশীরা তো করবে। করছে ও। না, যুদ্ধবিরতি কেউই ঘটাবার জন্য কেউই উপরে কোন চাপ দেয়নি। আমি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিলুম, কেননা আমার মনে হয়েছিল যে, এটাই আমাদের পক্ষে ঠিক কাজ হবে। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে জনসাধারণ যখন বিহ্বল, তখনও— যেমন ব্যক্তিগত আলোচনায়, তেমনি প্রকাশ্য ভাষণে— আমার কথায় ছিল সতর্কতার সুর। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে, নতুন নতুন সমস্যা দেখা দেবে। তাই যেটা করবার, সেটা তো করতেই হবে। তাকে এড়িয়ে যাবার উপায় তো নেই।
ধরা যাক, বাংলাদেশের ব্যাপারে আমরা যদি হস্তক্ষেপ না-ই করতুম। কি হত তাহলে? বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা পেত। কিন্তু যেমন তাদের, তেমনি আমাদেরও ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হত। এটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম। একই সঙ্গে তখন এও বুঝেছিলুম যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে আমাকে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। একটা দেশ যে তখন কি করেছিল, তা তো কেউ মনে রাখেনি। সত্যি বলতে কি, এমন কাজ এর আগে আর কোথাও কোন দেশ করেছে কিনা, তাতে আমার সন্দেহ আছে। কী করেছিলুম আমরা তখন? না চূড়ান্তভাবে একটা যুদ্ধে জিতে বলেছিলুম, ‘‘এবারে তোমরা তোমাদের মত থাকো, তোমাদের ব্যাপারে আমরা নাক গলাতে চাইনা, আর আমাদের জন্যেও কিছু চাইনা আমরা।’’
আমার জীবন দর্শন এটাই আমাকে শিখিয়েছে যে, মানুষ নিজে কিছু নয়, আসল ব্যাপার হচ্ছে নানা ঘটনা, নানা পরিবেশ, নানা আন্দোলন, যা তাকে তৈরি করে তোলে। সে যে একটা কিছুর অংশ, এটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার এই জীবন দর্শনের উপরে বেদান্তের প্রভাব আমি স্বীকার করি। স্বামী বিবেকানন্দের প্রসঙ্গে বলি, আমার মা বস্তুত সেখানে দীক্ষাই নিয়েছিলেন, আর আমার উপরে আমার মায়ের প্রভাব অনেকখানি।
[নিমাইসাধন বসু প্রণীত ‘আমি: ইন্দিরা গান্ধী’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল। সৌজন্য: আনন্দ পাবলিশার্স]
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy