Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বর্ষা-সাঁঝে রোমাঞ্চের হাতছানি

পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে কাদম্বিনী মরে গিয়ে প্রমাণ করল যে সে মরেনি। লিখছেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়।বর্ষা আসছে—কোথায় ছাতা, বর্ষাতি, স্যান্ডাল এ সব গুছিয়ে রাখব, প্রস্তুত হব মুম্বইয়ের দুরন্ত বৃষ্টি-দিনগুলোর জন্য—তা নয়, এই বৃষ্টি দিনে অন্য রকম কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, আপনাদের মাঝে মাঝে মনে হয় না কোন এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় মুড়ি তেলেভাজা সহযোগে বসি পরিবারের আর সকলের সঙ্গে। সেখানে হয়তো থাকতে পারে আরও কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় পরিজন।

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

বর্ষা আসছে—কোথায় ছাতা, বর্ষাতি, স্যান্ডাল এ সব গুছিয়ে রাখব, প্রস্তুত হব মুম্বইয়ের দুরন্ত বৃষ্টি-দিনগুলোর জন্য—তা নয়, এই বৃষ্টি দিনে অন্য রকম কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, আপনাদের মাঝে মাঝে মনে হয় না কোন এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় মুড়ি তেলেভাজা সহযোগে বসি পরিবারের আর সকলের সঙ্গে। সেখানে হয়তো থাকতে পারে আরও কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় পরিজন। বাইরের নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ— মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি ফালা ফালা করে দিচ্ছে অন্ধকারকে। এমন সময় হঠাৎ নিভে যায় ঘরের আলো। লোডশেডিং না কি ফিউজ গেল তা কে জানে! কেন পাওয়ার কাট, তার কারণ না হয় পরেই অনুসন্ধান করা যাবে। আগে তো একটা মোমবাতি জ্বালা হোক। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় ঘরের ছায়াগুলো নড়তে থাকে। জানালা দিয়ে ধেয়ে আসা হাওয়ায় মোমবাতিও নিভু-নিভু। ঘর জুড়ে যেন কী এক রহস্যের উদ্ভাস। জীবন আর মৃত্যুর সীমারেখা তো এমনই ছায়া-ছায়া, অস্পষ্ট, বৃষ্টিদিনের মতো মেঘ-আবরণে ঢাকা। কেউ বলতে পারে না কোথায় জীবনের শেষ আর মৃত্যুর আরম্ভ।
গল্প শুরু হয়। গল্প না কি ঘটনা না কি মানবমনের বিচিত্র পথ বেয়ে বয়ে আসা অজানিত শঙ্কা?
আসুন, সুধিজন, আমরা ডুব দিই সেই সব রহস্য কাহিনীতে।
অনেক অনেক দিন আগে বাল্টিমোরের এক প্রতিবেশী শহরে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। সেই শহরের এক নামকরা আইনজ্ঞের স্ত্রী হঠাৎই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করেও তাঁর রোগ নিরাময়ে ব্যর্থ হন। ভদ্রমহিলা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অথবা বলা যায় আপাতদৃষ্টিতে মনে হল তাঁর জীবনের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর মৃত্যু হয়নি—এটা ভাবার কোনও কারণ ছিল না কারণ, তাঁর শরীরে মৃত্যুর সমস্ত লক্ষণ ছিল একেবারে স্পষ্ট। ঠোঁট সাদা, চোখের পাতা পলকহীন, নাড়ির গতি বন্ধ, দেহ বরফশীতল। তিন দিন ভদ্রমহিলাকে কবর দেওয়া হল না। ওই বরফশীত ও মৃত্যুকঠিন দেহটিকে এর পর তাদের পারিবারিক ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষে সমাধিস্থ করা হল কারণ তা না হলে দেহে পচন ধরবে। তিন বছর এ ভাবেই ছিল দেহটি। তিন বছর পর এক দিন ভদ্রমহিলার স্বামী একটি শবাধারের জন্য ওই ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষটি খুলতেই আতঙ্কে উঠে ছিটকে বেরিয়ে এলেন।

কী দেখলেন তিনি? ভেতরের দরজা খুলতেই সাদা পোশাক পরা একটা জিনিস হুড়মুড় করে তাঁর হাতের ওপর এসে পড়ল। এটা আর কিছু নয়—তাঁরই স্ত্রীর কঙ্কাল, শবাচ্ছাদনকারী বস্ত্রের দ্বারা আবৃত। কী করে ঘটল এমন ভয়াবহ অভাবনীয় ঘটনা?

অনুসন্ধান করে জানা গেল, ভদ্রমহিলাকে সমাধিস্থ করার দু’দিন পর তিনি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। কফিনের ভেতর থেকে ভদ্রমহিলার বেরনোর আপ্রাণ চেষ্টার ফলে উঁচু তাক থেকে পড়ে কফিনটি ভেঙে যায়। ভদ্রমহিলা কফিনের ভেতর থেকে বেরোতে সক্ষম হলেও সমাধিকক্ষের লোহার দরজায় বার বার আঘাত করেও তিনি কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। একটি লণ্ঠনকে মেঝেতে উল্টে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সম্ভবত ভদ্রমহিলার ধাক্কাধাক্কিতেই সেটি পড়ে যায়। অনেক চেষ্টার পরও যখন দরজা খোলে না, তখন হতাশায়, ভয়ে ভদ্রমহিলা সম্ভবত প্রাণত্যাগ করেন। সমাধিকক্ষের লোহার দরজায় কোনও ভাবে আটকে যায় তাঁর সাদা আচ্ছাদন আর ওই অবস্থাতেই তিনি রয়ে যান তিন বছর। দেহে পচন ধরে এবং অবশেষে দেহটি পরিণত হয় একটি কঙ্কালে। আর একটি এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ১৮১০ সালে ফ্রান্সে।

এই কাহিনি কোনও গল্প বা উপন্যাসকেও হার মানায়। এই কাহিনির প্রধান চরিত্রও একজন সুন্দরী সম্ভ্রান্ত যুবতী। মাদমোয়াজেল ভিক্টোরাইন ল্যাফারকেড। এই যুবতীর অনেক পাণিপ্রার্থীর মধ্যে এক জন জুলিয়েন বসুয়েট—সে প্যারিসের এক দরিদ্র সাংবাদিক বা সাহিত্যিক। মেয়েটি এই ছেলেটিকে ভালবাসত কিন্তু বাংশগৌরবের গরিমায় মেয়েটি ছেলেটিকে প্রত্যাখ্যান করে বিবাহ করল এক ধনী কূটনীতিবিদকে—মঁসিয়ে রেনেল। বিয়ের পর কিন্তু মেয়েটি মোটেই সুখী হল না। মঁসিয়ে রেনেল তার স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে লাগল এবং কয়েক বছরের চূড়ান্ত অসুখী দাম্পত্যজীবনের সমাপ্তি ঘটল মেয়েটির মৃত্যুতে। সমাধিস্থ করা হল ভিক্টোরাইনকে— তারই গ্রামের এক সমাধিক্ষেত্রে। প্রেমিকার মৃত্যু সংবাদে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ল জুলিয়েন—মেয়েটির পূর্ব প্রেমিক। মেয়েটির সঙ্গে আত্মিক বন্ধনের তাগিদে সে যাত্রা করল সেই গ্রামের উদ্দেশে। সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছে মধ্যরাতে সে মাটি খুঁড়ে বের করল কফিনটি এবং সেটির ঢাকনা খুলে ফেলল। প্রিয়তমার মাথার চুল স্মারক হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য সে হাত বাড়াতেই দেখল এ কি প্রেমিকা তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

মেয়েটির বাস্তবে মৃত্যুই হয়নি। সাময়িক স্তব্ধ হয়েছিল জীবনের গতি। প্রেমিকের আদরে স্পর্শে সে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। অর্থাভাবে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে ফিরে আসার পর মেয়েটি আর তার স্বামীর কাছে ফিরে গেল না। সে তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেল আমেরিকায়। কুড়ি বছর পর তারা আবার ফিরে এল ফ্রান্সে। মেয়েটিকে তার বন্ধুবান্ধবরা চিনতে অপারগ হলেও তার প্রথম স্বামী কিন্তু তাকে চিনতে ভুল করেনি। সে তার স্ত্রীর অধিকার দাবি করে। সে দাবি আদালত অবধিও গড়ায়। কিন্তু আইনও মানবিক অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয়। নস্যাৎ হয়ে যায় মেয়েটির প্রথম স্বামীর দাবি।

এ বার আর একটি কাহিনির অবতারণা করা যাক। এটিও কম রোমহর্ষক নয়। বিশালদেহী এবং শক্তপোক্ত চেহারার এক গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেলেন এবং জ্ঞান হারালেন। তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছিল, রক্তক্ষরণ হচ্ছিল খুব। ক্রমে তাঁর অবস্থার অবনতি হতে লাগল এবং অবশেষে মনে হল যে তিনি মারাই গেছেন। সে দিন আবহাওয়া ছিল উষ্ণ, ভদ্রলোককে একটি সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্থ করা হল। তাঁর অন্তোষ্টিক্রিয়া সমাপন হয়েছিল কোনও এক বৃহস্পতিবার। সেই সপ্তাহের শেষে রবিবার সেই সমাধিক্ষেত্রে স্বভাবতই মৃতদের আত্মীয় বা বন্ধুদের সমাগমে ছিল পূর্ণ। সে দিন দুপুরবেলা এক কৃষকের চিৎকারে ওই সমাধিক্ষেত্রে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। ব্যাপারখানা কী? না, কৃষকটি ওই অফিসারের সমাধির ওপর বসেছিল। হঠাৎই তার মনে হল যেন সে যেখানে বসে আছে সেখানকার মাটি কাঁপছে—যেন ভূগর্ভে একটা আলোড়ন চলছে। প্রথমে লোকজন কৃষকের কথায় সে রকম কর্ণপাত করল না। কিন্তু ওই মানুষটিও একগুঁয়ে—যা ঘটেছে সে সম্বন্ধে সে নিশ্চিন্ত। অতএব আনো কোদাল। মাটি কোপাও। কী আছে সমাধির অভ্যন্তরে দেখতেই হবে। সৌভাগ্যের ব্যাপার যে সমাধিটি সে রকম গভীর ছিল না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাটি খুঁড়ে ফেলা হল এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে সকলে লক্ষ করল যে ওই অফিসার কফিনের ভেতর প্রায় বসে আছেন। ধস্তাধস্তিতে কফিনের ঢাকনা কিছুটা খোলা এবং তাঁর মাথাটা দেখা যাচ্ছে। যাকে মৃত বলে মনে হয়েছিল তিনি জীবিত।

এ রকম ঘটনা আরও কত যে আছে। ১৮৩১ সাল। লন্ডন শহরের এক তরুণ আইনজীবী মিস্টার এডোয়ার্ড স্টেপলটন । টাইফাস জ্বরে মারা যান। কিন্তু কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ বা উপসর্গের জন্য ডাক্তাররা কিছু ডাক্তারি পরীক্ষা করতে চান ওই তরুণের দেহের ওপর। কিন্তু তার বন্ধুরা এতে রাজি না হওয়ায় দেহটিকে কবরস্থ করা হয়। এ দিকে চিকিৎসকরাও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। তারা দু’দিন পর তৃতীয় রাতে ওই মৃতদেহটি কবর থেকে তুলে এনে পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। দেহের ওপর ব্যাটারি দিয়ে পরীক্ষা করার সময়ই হঠাৎ সেই তরুণ দ্রুত উঠে মেঝেতে কয়েক পা হেঁটে কয়েকটি কথা বলেই দড়াম করে পড়ে যায়। হতবাক হয়ে যান চিকিৎসকেরা। পরবর্তী কালে সুস্থ হয়ে উঠে মিস্টার স্টেপলটন বর্ণনা করেছিলেন যে, তাঁকে মৃত ঘোষণা করার পর থেকে যা যা ঘটনা ঘটেছিল সমস্ত তিনি তাঁর অবচেতনে যেন অনুভব করতে পারছিলেন। কারণ, তিনি সম্পূর্ণ জ্ঞান হারাননি। পরীক্ষাগারে চিকিৎসকদের সামনে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি যে কটি শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, তা হল ‘আই অ্যাম অ্যালাইভ’। যদিও ওই শব্দটি যেন তাঁর নিজের অজান্তেই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।

সুধিজন, এতক্ষণে নিশ্চই আপনাদের গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ আমারও একই অবস্থা হয়েছিল যখন রহস্যকাহিনির বিখ্যাত লেখক এডগার অ্যালেন পো-এর ‘দ্য প্রিম্যাচিওর বেরিয়ল’ পড়েছিলাম —এই সব কাহিনি ওই ছোটগল্পেই বিবৃত করেছেন লেখক।এই ভাবে মৃত্যুর দরজায় গিয়েও যারা ফিরে আসে অথবা অন্য ভাবে বলা যায় যে, আপাতদৃষ্টিতে মৃত্যু হয়েছে ভেবে যাদের সমাধিস্থ করা হয়— মাটির নীচে কফিনের মধ্যে যদি তাদের জ্ঞান ফিরে আসে তা হলে কেমন হয় অবস্থাটা। সে কল্পনাও কী ভয়ঙ্কর! বুকের ফুসফুসের ওপর অসহনীয় চাপ, কষ্ট—শ্বাসরোধকারী ভিজে মাটির গন্ধ—গায়ের সঙ্গে এঁটে থাকা শবাচ্ছাদন কফিনের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ জায়গা—অবিচ্ছেদ্য ভয়ানক অন্ধকার—সমুদ্রের মতো পরিব্যপ্ত অখণ্ড নীরবতা— গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া অদেখা কৃমিকীটের স্পর্শগ্রাহ্য অনুভূতি—এ সবই কি ভয়ানক! অথচ একই সঙ্গে এও মনে হয় মাটির ওপর আলো, বাতাস, ঘাসে ঢাকা সুন্দর পৃথিবী—জীবনের স্পন্দন ধ্বনিত হচ্ছে যেখানে। ওপরে রয়েছে বন্ধুরা যারা জানতে পারলে তক্ষুণি ছুটে আসবে বাঁচাতে। কিন্তু হায়, মাটির নীচ থেকে কী ভাবে জানানো যাবে তাদের যে, মানুষটি জীবিত। চরম দুর্ভাগ্য—বলা যেতে পারে নরকদর্শনের মতো দুর্ভাগ্য।

এডগার অ্যালেন পো বিশ্ববিখ্যাত রহস্যকাহিনির লেখক। তাঁর লেখায় অদ্ভুত ভাবে বর্ণিত হয়েছে মানব মনের বিচিত্র অলিগলি। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি পরতে পরতে উন্মোচিত করেছেন মানব মনের রহস্য-নির্যাস। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে গায়ে শিহরণ জাগে।

মানুষের জীবনে অপ্রত্যাশিত ভাবে কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে। অনেক সময় কোন বিশেষ অবস্থায় মানুষ একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতে পারে। আসলে এটা একটা রোগ—ডাক্তারি পরিভাষায় একে ক্যাটালেপ্সি বলা হয়। এই অবস্থায় রোগীর চেতনা বা অনুভূতি বিলুপ্ত হয়— দেহ শক্ত ও আড়ষ্ট ওঠে। মানুষটি ডুবে যেতে থাকে অচেতনতার গভীরে। এই অবস্থা অল্পক্ষণের জন্যও হতে পারে বা দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এমন অবস্থা থাকলে হয়তো তাকে মৃত্যু বলেও ভুল হতে পারে।

লেখক এডগার অ্যালেন পো এই রকম অবস্থার বর্ণনা করেছেন জীবন্ত ভাষায়। লেখকের বর্ণনায় তিনি নিজেই যেন ক্যাটালেপ্সির শিকার। এ রকম অবস্থায় তাঁর মনে সর্বক্ষণ একটা ভীতি—তবে কি চূড়ান্ত মৃত্যুর আগেই চলে যেতে হবে কবরে?

যেন এক বরফশীতল অনুভূতি একটা ভ্রমণের মধ্যে ক্রমশ নিমজ্জিত হতে থাকা। চারপাশের বিষণ্ণতাঘেরা অন্ধকারের মধ্যে ডুবতে ডুবতে হঠাৎ মনে হয় কে যেন বরফশীতল হাত রাখল কপালে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল কব্জি, চেতনারে ঝাঁকুনি দিয়ে ওই রহস্যময়তার গভীর থেকে ভেসে এল একটা কণ্ঠস্বর—

জাগো, জাগো ওঠো!

কে তুমি? কে?

আমি যেখানে থাকি সেই জায়গাটার কোনও নাম নেই। আমি প্রাণঘাতী পিশাচ, আমি নিষ্ঠুর কিন্তু তবু আমি তোমাকে করুণা করি। এই নিশ্চিদ্র চিররাত্রির অন্ধকার অসহ্য। তুমি কী করে এমন প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছো? এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না। ওঠো, বেরিয়ে এসো। উঠে-এসো কবরের অভ্যন্তর থেকে। চিররাত্রির অন্ধকারের বাইরে চলে এসো।

শরীরে রক্ত চলকে উঠল—শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল মৃত্যুশীতল শিহরণ। পৃথিবীর অসংখ্য অজস্র্ কবরের মধ্যে যারা প্রাণহীন তারা অনড়, অটল কিন্তু সেই সব দেহ যাদের তখনও চূড়ান্ত মৃত্যু হয়নি, তারা কী নড়ে উঠল? কিন্তু হায়, কী গভীর এ অন্ধকার আর কি শক্ত কফিনের ডালা! সশব্দে যেন বন্ধ হয়ে যায় সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসার সমস্ত রাস্তা! সেই কণ্ঠস্বর তীব্র হতাশায়, ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠে—ওহ, কী অদ্ভুত দৃশ্য, করুণা হয় ঈশ্বর, এদের জন্য করুণা হয়!

না, এটা বাস্তব নয়—লেখকের মনের অবচেতন থেকে উঠে আসা অবাস্তব কল্পনা। গভীর রাতে এই ধরনের উদ্ভুট কল্পনা অদ্ভুত এক আতঙ্ক সৃষ্টি করে। মনে হয়, সত্যিই যদি চূড়ান্ত মৃত্যু আসার আগেই ভুলক্রমে সমাধিস্থ করা হয়। লেখকের মনে ভিড় করে আসা একে একে অনেক সাবধানতা। পারিবারিক সমাধিকক্ষটি তবে অমন ভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে ভেতর থেকে দরজা খোলা যায়। কক্ষের ভেতর যেন আলো, বাতাস ফেলতে পারে। থাকে যেন জল ও খাবার। কফিনটিও যেন এমন ভাবে বানানো হয় যে তাতে সুদৃশ্য গদি থাকে এবং তার ঢাকনা সহজেই ভেতর থেকে খুলে ফেলা যায়। উপরন্তু সমাধিকক্ষের চূড়ায় যেন একটি ঘণ্টা থাকে যে ঘণ্টার দড়িটি কফিনের চাকনার ভেতরে বাঁধা থাকবে দেহের হাতের সঙ্গে।

কিন্তু এত কিছু করেও কি শেষরক্ষা হবে। লেখকের মনে শঙ্কা মানুষের নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে যাবে না তো অন্য পথে!

তবে সবই একটি ভীতি—একটা অজানিত শঙ্কা এবং পুরো ব্যাপারটাই মনস্তাত্ত্বিক। ব্যতিক্রমী ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে, তবে তাই বলে ভয়ে ঘরের কোণে চুপ করে বসে থাকব তা তো নয়। হ্যাঁ, তবে এও ঠিক যে এই সব ঘটনা মানুষকে হয়তো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেও বাধ্য করে। জীবন ও মৃত্যুর দোলাচলে দোদুল্যমান এমনই একটি ঘটনা নিয়েই তো লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ ছোট গল্পটি। সেখানেও এক বর্ষার রাতে সাময়িক ভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া কাদম্বিনী প্রাণ ফিরে পেয়ে শ্মশান থেকে উঠে এসেছিল। কিন্তু সমাজ সংসার কী তাকে গ্রহণ করেছিল? সে যেন দাঁড়িয়েছিল জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শেষমেশ তার নিজেরও যেন মনে হয়েছিল—সে কী সত্যিই জীবিত মানুষ না কী প্রেতাত্মা। নিজের কপাল ফাটিয়ে রক্ত বের করেও সে তার পরিবারের মানুষদের বোঝাতে পারেনি যে সে মরেনি। তাই অবশেষে সে চূড়ান্ত মৃত্যুর পথই বেছে নিয়েছিল পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে কাদম্বিনী মরে গিয়ে প্রমাণ করল যে সে মরেনি।

এই দেখুন, সুধীজন, লিখতে লিখতে কত কথা বলা হয়ে গেল। তা হলে এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় না হয় জমিয়ে বসা যাবে এই সব রহস্য গল্পের ভাণ্ডার নিয়ে। দেখবেন ঠিক গা ছমছম করে উঠবে আপনাদের সে দিন রাতে ঘুমোতে পারবেন তো?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE