চলতি মাসের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ঢাকা সফরে গেলেন, তখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের অনুপস্থিতিতে ভুরু কুঁচকেছিল অনেকের। কারণ প্রধানমন্ত্রী যখনই বিদেশে যান, তাঁর সঙ্গে থাকেন এই প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান।
কোন জরুরি কাজে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন তিনি, সেটা জানা গেল আজ। সাউথ ব্লকের এক কর্তা জানালেন, মোদীর ঢাকা সফরের সময় ডোভাল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওয়ার রুমে বসে সেনা অফিসারদের সঙ্গে মায়ানমারে জঙ্গি ঘাঁটি নির্মূল করার নীল নকশা তৈরি করছিলেন।
সেই নকশা মেনেই সোমবার গভীর রাতে মায়ানমারের ওনজায় অভিযান চালিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দাবি, ৪৫ মিনিটের অপারেশনে মারা গিয়েছে ৩৮ জন জঙ্গি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এনএসসিএন-খাপলাং গোষ্ঠীর দু’টি জঙ্গি শিবির। জঙ্গিদের তরফে অভিযানের খবর অস্বীকার করা না হলেও দাবি করা হয়েছে, তাদের গায়ে আঁচ পড়েনি। উল্টে ভারতীয় সেনারাই তাড়া খেয়ে পালিয়েছে। নিজেদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে যে দাবি স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন সেনাকর্তারা।
মায়ানমার আবার দাবি করেছে, তাদের মাটিতে ভারত কোনও অভিযান চালায়নি। প্রেসিডেন্টের দফতরের ডিরেক্টর জ তে আজ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘ওই এলাকায় থাকা ব্যাটেলিয়ন সূত্রে আমরা জেনেছি যে, ভারত সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় নিজেদের ভূখণ্ডেই সেনা অভিযান চালিয়েছে।’’ সেনাকর্তারা এর মধ্যেও অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না। কারণ, নিজের দেশে অন্য দেশের সেনা অভিযান চালালে মুখ পোড়ে বই কি!
কিন্তু এমন বিরল অভিযানের সিদ্ধান্ত কেন নিল নয়াদিল্লি? প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্র বলছে, মায়ানমারে সেনা অভিযানের পটভূমিতে আছে উত্তর-পূর্ব ভারতে একের পর এক জঙ্গি হানার ঘটনা। যার জেরে মে মাসে নাগাল্যান্ডে মৃত্যু হয়েছে অসম রাইফেলসের ৮ জওয়ানের। ক’দিন আগেই সেনা কনভয়ে হানায় ১৮ জন মারা গিয়েছেন মণিপুরের চাণ্ডেল জেলায়। অরুণাচল প্রদেশের ছিন এলাকাতেও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সূত্র বলছে, উত্তর পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু জঙ্গি সংগঠন একত্রিত হচ্ছে। এই ছাতার তলায় রয়েছে এনএসসিএন-খাপলাং গোষ্ঠী। সম্প্রতি আট বছরের সংঘর্ষবিরতি ভেঙে বেরিয়ে এসেছে তারা। দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি হল, শোনবিজিত বড়ো গোষ্ঠী। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব বড়োল্যান্ডের অধীনে ছিল এই গোষ্ঠী। কোন্দলের জেরে শোন বিজিত গোষ্ঠী কাউন্সিল থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন এই তারা খাপলাংদের সঙ্গে এক ছাতার তলায় এসেছে। এ ছাড়া আছে মণিপুরের কেওয়াইকেএল গ্রুপ, আলফা-র পরেশ বরুয়া গোষ্ঠী এবং আরও দু’টি জঙ্গি সংগঠন।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ, চিনা সেনার একাংশ এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সংগঠিত করতে সাহায্য করছে। তাঁদের বক্তব্য, লালকৃষ্ণ আডবাণী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন এক বার আইএসআই উত্তর-পূর্বের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে একজোট করেছিল। এ বার চিনা সেনাবাহিনী সেই একই চেষ্টা করছে। যদিও এই অভিযোগ ‘অসম্ভব এবং অবাস্তব’ আখ্যা দিয়ে অস্বীকার করেছে চিন।
উত্তর-পূর্বে ক্রমবর্ধমান জঙ্গি তৎপরতা দেখে গত মাসেই মোদী সিদ্ধান্ত নেন, মায়ানমারের ঘাঁটিগুলিকে নির্মূল করতে হবে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে ব্রজেশ মিশ্র যখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তখন ভুটানে জঙ্গি ঘাঁটি ভাঙার অভিযানের মূল কারিগর ছিলেন ডোভালই। এ বারও তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভুটানে অভিযান চালানোর সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আডবাণীকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেছিলেন বাজপেয়ী। এ বার মায়ানমারে অভিযানের খবর ছিল না রাজনাথ সিংহের কাছে। সবটাই মোদী-ডোভাল যুগলবন্দি।
৪ জুন ডোভাল মণিপুর গিয়ে রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের প্রক্রিয়া অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল তার আগেই। সম্প্রতি সে দেশে গিয়েছিলেন বিদেশসচিব জয়শঙ্কর। সেখানে মায়ানমারের সেনাকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, সন্ত্রাস ও মাদক পাচার-চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে ভারত-মায়ানমার চুক্তি হয়েছিল ২০১০ সালের জুলাইয়ে। নয়াদিল্লি প্রায় দু’দশক ধরে চাপ দেওয়ার পরে ওই চুক্তি সই করেছিলেন মায়ানমারের তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রধান থান স্যু। ওই চুক্তিতে তাদের মাটিতে গ্রেফতার হওয়া ভারতীয় জঙ্গিদের হস্তান্তর করতেও সম্মত হয় মায়ানমার। যার বদলে মায়ানমারে সড়ক, রেল, নির্মাণ ও কৃষিক্ষেত্রে প্রায় ৯৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় নয়াদিল্লি।
সেই চুক্তির সূত্র ধরেই জয়শঙ্কর অভিযানের ব্যাপারে আলোচনা করেন মায়ানমারের সেনাকর্তাদের সঙ্গে। তাঁর দৌত্যে কাজ হয়। মায়ানমার সরকার জানিয়ে দেয়, সেনা অভিযানের সময় তারা চুপ থাকবে। উল্টে পরিকাঠামোগত সব রকম সাহায্য করবে। সেনা অভিযানের ক্ষেত্রে এই সাহায্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্র বলছে, মায়ানমার যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল, তার পিছনে রয়েছে সফল কূটনীতি। চিনের প্রভাব থেকে মায়ানমারকে অনেকটাই মুক্ত করে আনা সম্ভব হয়েছে। কূটনীতির পাশাপাশি আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। মায়ানমার ও ভারতের মধ্যে সীমান্তের দৈর্ঘ্য ১৬৪৩ কিলোমিটার। এই সীমান্ত নিয়ে দু’দেশের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ২০১২ সালে মনমোহন সিংহ যখন মায়ানমার যান, তখন সীমান্ত বিবাদ নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় উন্নয়নের প্রস্তাব নেওয়া হয়। এ বারও সেনা অভিযানের আগে ওই এলাকায় উন্নয়নের কাজে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে নয়াদিল্লি। আগে এই কাজটাই করত চিন। মায়ানমারকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বন্দর নির্মাণে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে ভারত। এ দিনই জানা গিয়েছে যে ডোভাল খুব শীঘ্রই মায়ানমার যাবেন, জঙ্গি দমনের পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনা করতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy