Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

দড়ি বেয়ে পাহাড় ভেঙে রোগীর পাশে মহিলা চিকিৎসক

পাহাড়ের উপরে গভীর জঙ্গলে ছোট্ট গ্রাম। সেখানে বাস করে অবলুপ্ত হতে বসা প্রাচীন জনজাতি। মেরেকেটে এখন তাঁদের সংখ্যা ২০০-২২০। কেরলের মলপ্পুরম জেলার এর্নাদ তালুকে সেই হারিয়ে যেতে বসা ‘চোলানায়কর’ জনজাতির এক মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচাতে বৃষ্টির মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ দড়িতে ঝুলে-ঝুলে পিচ্ছিল পাহাড়ে উঠে চিকিৎসা করে এসেছেন এক তরুণী সরকারি চিকিৎসক।

রোগীকে দেখতে দড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠছেন অশ্বথী। —নিজস্ব চিত্র

রোগীকে দেখতে দড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠছেন অশ্বথী। —নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৮ ০৩:৫০
Share: Save:

পাহাড়ের উপরে গভীর জঙ্গলে ছোট্ট গ্রাম। সেখানে বাস করে অবলুপ্ত হতে বসা প্রাচীন জনজাতি। মেরেকেটে এখন তাঁদের সংখ্যা ২০০-২২০। কেরলের মলপ্পুরম জেলার এর্নাদ তালুকে সেই হারিয়ে যেতে বসা ‘চোলানায়কর’ জনজাতির এক মরণাপন্ন রোগীকে বাঁচাতে বৃষ্টির মধ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ দড়িতে ঝুলে-ঝুলে পিচ্ছিল পাহাড়ে উঠে চিকিৎসা করে এসেছেন এক তরুণী সরকারি চিকিৎসক।

জেলার স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাই জানাচ্ছেন, এক যুগের মধ্যে এই প্রথম কোনও চিকিৎসক ওই দুর্গম গ্রাম ‘পানাপ্পুঝা উরু’তে পা রাখলেন। পরে স্থানীয় কয়েক জনের সাহায্যে অসুস্থ প্রৌঢ়কে নামিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন তিনি। অস্ত্রোপচারের পর আপাতত বিপন্মুক্ত রোগী।

চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান অবনতির আবহে ব্যতিক্রমী বৃষ্টি হয়ে এসেছে এই ঘটনা, যেখানে রোগীকে বাঁচাতে নিজের জীবন বিপন্ন করে নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় দড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠেছেন বছর তিরিশের অশ্বথী সোমান। চিকিৎসক দিবসের প্রাক্কালে শুভেচ্ছায় ভেসে যাচ্ছেন তিনি।

সাড়ে চার বছরের শিশুপুত্র ও আড়াই বছরের শিশুকন্যার মা অশ্বথীর কথায়, ‘‘এই জনজাতির মানুষ সভ্য জগতের সংস্পর্শ এড়িয়ে থাকতে চান। ওই রোগীও সমতলে আসতে চাইছিলেন না। অথচ তাঁর পায়ে পচন ধরেছিল। কড়ে আঙুল খসে গিয়েছিল। এটা জানার পর আমি আর বসে থাকতে পারিনি।’’ টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে হেসে লাজুক গলায় বলেন, ‘‘আমাকে অবশ্য আত্মীয়-বন্ধুদের অনেকে বকাবকি করেছেন। দড়ি বেয়ে ওঠার সময় পা হড়কালেই খাদে তলিয়ে যেতাম। আমি তাঁদের বলেছি, ভাগ্যে থাকলে মরতাম, বড় হয়ে আমার ছেলেমেয়ে যখন জানতে পারত, তখন আমাকে নিয়ে গর্বই করত।’’

মলপ্পুরমের জেলা মেডিক্যাল অফিসার সাকিনা জানাচ্ছেন, গোটা জেলায় তাঁদের তিনটি মোবাইল ডিস্পেনসারি রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম নীলাম্বুর মোবাইল ডিস্পেনসারি। সেখানে মাস আটেক আগে মেডিক্যাল অফিসার হয়ে যোগ দেন অশ্বথী। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা ওই এলাকায় একাধিক জনজাতির বাস। এঁদের মধ্যে একমাত্র ‘চোলানায়কর’-রাই পাহাড়ের উপরে জঙ্গলে থাকেন। প্রতি বুধবার পাহাড়ের নীচে মানচেরি এলাকায় মোবাইল ইউনিটে কেউ-কেউ চিকিৎসা করাতে আসেন।

অশ্বথী জানান, গত ১৯ জুন তাঁরা খবর পান ওই গ্রামে রেভি নামে এক মধ্যবয়স্ক খুব অসুস্থ। কিন্তু তিনি ডাক্তারখানায় আসতে ভয় পাচ্ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। ১২ জনের দল তৈরি হয়, যেখানে একমাত্র চিকিৎসক অশ্বথী, বাকিরা মূলত ‘অ্যান্টি নকশাল থান্ডারবোল্ট টিম’-এর সদস্য। ২০ জুন সকালে যাত্রা শুরু হয়। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই গাড়ি থেমে যায়। সামনে গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ। অশ্বথীর কথায়, ‘‘জীবনে কখনও ট্রেকিং করিনি। সে দিন দড়িতে ঝুলে-ঝুলে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাহাড়ে চড়তে হয়েছে।’’

রেভির প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে হাসপাতালে আসার জন্য অনেক বুঝিয়ে রাজি করান অশ্বথী। পিঠে করে তাঁকে বয়ে নীচে নামানো হয়। অশ্বথীর ভাষা বোঝেন না। কিন্তু এখন রেভি তাঁকে দেখলেই একগাল হাসেন। অবিশ্বাস ভেঙে চিকিৎসককে ভরসা করতে পারার হাসি।

অন্য বিষয়গুলি:

doctor Patient Kerala Eranad Malappuram
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE