মহড়া। শুক্রবার রাজপথে বিশ্ব যোগ দিবস উপলক্ষে অনুশীলনে ব্যস্ত এক প্রতিযোগী। ছবি: পিটিআই।
‘মোরারজি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব যোগ’ ভবনটি সম্বচ্ছর গাছের ছায়ায় শান্ত দাঁড়িয়ে থাকে অশোক রোডের ধারে। পক্ষকাল ধরে সেই শান্তি পগার পার যোগদিবসের ঠেলায়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধে এখানকার প্রশস্ত হলগুলিতে ঘড়ি ধরে ঘাম ঝরাচ্ছেন তাঁরা, যাঁদের জীবনযাপন এত দিন ডুবে ছিল ঘি-মাখন-বিয়ার-বার্গারে। ২১ তারিখ রাজপথে যোগ-কুচকাওয়াজের পর সেই বপু-বিলাসে কোনও পরিবর্তন আসবে কি না, তা ভবিষ্যতই বলবে। আপাতত আয়ুষ মন্ত্রকের দেওয়া সরকারি নোটিস মান্য করে কেন্দ্রীয় সরকার এবং দিল্লি পুলিশের কর্মীরা মহড়া দিতে রোজ ‘জো হুজুর’ হচ্ছেন এই ভবনে।
লুটিয়ানের দিল্লি এখন যোগের দখলে। ২১ তারিখ গোটা বিশ্বেই যাতে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালন হয়, রাষ্ট্রপুঞ্জে গিয়ে সেই ব্যবস্থা করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজধানীতে মূল অনুষ্ঠান হবে ইন্ডিয়া গেটের সামনে রাজপথে। মোদী সরকার আশা করছে, ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে ২১ তারিখ সাতসকালে হাজির করানো যাবে রাজপথে। যা কিনা বিশ্ব রেকর্ড হতে চলেছে। ইন্ডিয়া গেটের সামনে বিশাল মঞ্চ তৈরির কাজ প্রায় শেষ। রাজপথের দু’দিকে হাজারখানেক বিশালকায় টিভি স্ক্রিন। আয়োজন-প্রস্তুতি মনে পড়াচ্ছে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের কথা। ক্যাবিনেট সচিব পি কে সিন্হা নিয়মিত তদারকি করছেন। মূল অনুষ্ঠানের আগে সকলকে এক মাস ধরে যোগাসন অভ্যাস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাউথ বা নর্থ ব্লকের অলিন্দে বিকেলে ছুটির পরে আমলা-পিওন-নিরাপত্তা কর্মীরা সারি বেঁধে বক্রাসন বা পবন-মুক্তাসন করার চেষ্টা করছেন।
করতেই হবে। মনের মধ্যে কি কাজ করছে না একটা চোরা ভয়ও? এই দুর্দান্ত গরমে জলের বোতল আর কিট ব্যাগ হাতে হাঁপাতে হাঁপাতে যারা আসছেন, তাদের মধ্যে এক জন পবন চৌবে। জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এই কর্মীর বয়স মধ্য পঞ্চাশ। দেখেই বোঝা যায়, দফতর যাতায়াতটুকু (যদিও সেটা মেট্রোতে) ছাড়া সুস্থ শরীরকে খামোখা ব্যস্ত করায় বিশ্বাসী নন! তবু সরকারকে গিনেস বুকে তোলার তাড়নাতেই কি এই অভ্যাস বদল? আমতা আমতা করে চৌবে জানাচ্ছেন একটি সার্কুলারের কথা, যেটা তাঁর মন্ত্রকের মতো অন্য অনেক মন্ত্রকেই পৌঁছেছে। যার মোদ্দা কথা হল, ২১ তারিখের আগে নিজেদের যথেষ্ট তৈরি করে নিতে হবে। যদি কেউ ‘তৈরি’ হয়ে না-আসেন, তা হলে কেরিয়ার-রেকর্ডে ঢেরা পড়তে পারে! পদ-হস্তাসন করতে গিয়ে হাত-পা ঠিক জায়গায় না পৌঁছলে যদি গিনেস রেকর্ড হাতছাড়া হয়ে যায়, তার কোনও মাফ নেই!
প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় এবং কর্মিবর্গ দফতরের মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ কিন্তু বলছেন, বাধ্যবাধকতা নয়। আধিকারিকরা নিজে থেকেই ঘাম ঝরাচ্ছেন। ‘‘বিভিন্ন মন্ত্রকের কর্মীদের কাছ থেকে দিস্তা দিস্তা চিঠি পাচ্ছি। যোগ দিবস উদযাপনের দিন উপস্থিত থাকতে চেয়ে চিঠি দিচ্ছেন ওঁরা।’’ শুধু দিল্লি কেন, সিয়াচেন বেস-এর সেনা-জওয়ানরা কিংবা যুদ্ধজাহাজের নৌসেনা কর্মীরাও যোগাভ্যাস করছেন।
মোরারজি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব যোগের ডিরেক্টর ঈশ্বর বাসবরেড্ডি স্যুট-টাইয়ের বদলে দশ দিন ধরে পুরোদস্তুর সাদা ট্র্যাক-স্যুট পরে আসছেন! ভবনের গুঞ্জন, প্রস্তুতি কেমন চলছে দেখতে নাকি আকস্মিক ভিজিট করতে পারেন স্বয়ং ‘মোদী সাব’! বাসবরেড্ডি বললেন, ‘‘অনেকেই এমন আসছেন যাঁরা কখনও যোগাভ্যাস করেননি। কিন্তু পাঁচ ছ’দিন করার পরেই তাঁরা বলছেন, শারীরিক ব্যথা-বেদনার উপশম পাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও যোগাসন চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাই প্রকাশ করছেন তাঁরা।’’
আমজনতার কাছে এমনিতে আয়ুষ মন্ত্রক খুব একটা পরিচিত নয়। মনমোহন জমানার একেবারে শেষ পর্বে আয়ুষ মন্ত্রকের আবির্ভাব। আয়ুর্বেদ, যোগ, নেচারোপ্যাথি, ইউনানি, সিদ্ধা ও হোমিওপ্যাথির শিক্ষা ও গবেষণার প্রসারণই এর উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হতে চলেছে এই মন্ত্রকের প্রথম ‘মেগা ইভেন্ট’। এই শক্ত পরীক্ষার মুখোমুখি যিনি, সেই মন্ত্রী শ্রীপদ নায়েক নিজে দিনের আলো ফোটার আগে ঘুম থেকে উঠে রোজ যোগাসন করেন। জানালেন, ‘‘২১ জুন সকালের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাবিনেট মন্ত্রী, সাংসদ, রাষ্ট্রদূতরা থাকবেন। তাঁদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারী, ছাত্রছাত্রী, এনসিসি ক্যাডেট, আধাসেনা জওয়ান মিলিয়ে শুধু রাজপথেই ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ একসঙ্গে যোগাসন করবেন।’’ সব রাজ্যকে চিঠি লিখে নায়েক অনুরোধ করেছেন, রাজ্য রাজধানী, জেলা সদর এবং পঞ্চায়েত স্তরেও যেন যোগ দিবস পালন হয়।
মোট ৩৫ মিনিটের যোগ। সকাল ৭টা থেকে ৭টা ৩৫ মিনিট। ৫ মিনিটের হাত-পায়ের ব্যায়াম দিয়ে শুরু। তার পর ১৫ মিনিট সাধারণ কিছু যোগাসন, ৫ মিনিটের প্রাণায়াম, ৫ মিনিটের ধ্যান এবং সবশেষে সঙ্কল্প। শারীরিক কসরৎ শুরুর আগে থাকছে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ— ‘সমগচ্ছধ্বম সমবদধ্বম সম ভো মনামসি জানতাম’। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লাল কেল্লা থেকে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় এই মন্ত্রকেই তাঁর পথপ্রদর্শক হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন মোদী। অনুষ্ঠান শেষ হবে আর একটি শ্লোক উচ্চারণে— ‘ওম সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু, মা কশ্চিতদুখভাগভবেত। ওম শান্তি শান্তি শান্তি।’ এই মন্ত্রটি নিয়ে অবশ্য গোল বেধেছে, কারণ, আরএসএস-এর অনুষ্ঠানের শুরুতে এবং শেষে এই মন্ত্রই উচ্চারণ হয়! সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতারা বেঁকে বসেছেন। তাঁরা ‘ওম’ বলবেন না। শ্রীপদ নায়েক বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ওই বৈদিক মন্ত্র বা শ্লোকের সঙ্গে কোনও ধর্মের সম্পর্ক নেই। সংসদের দেওয়ালেও এই মন্ত্র খোদাই করা রয়েছে। ভারতের পাশাপাশি যে ১৭৭টি দেশে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালন হবে তার মধ্যে ৪৭টি ইসলামিক দেশের গোষ্ঠীভুক্ত। শ্রীপদ বলছেন, ‘‘যোগাসনের সঙ্গে কোনও ধর্মের সম্পর্ক নেই। বহু সংখ্যালঘু সংগঠনের প্রধানরা আমাকে এসে বলেছেন, নমাজ করার সময়ও যোগাসনে বসতে হয়। আমরা কাউকে যোগাসন করতে বাধ্য করছি না।’’
প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের প্রকল্প বলে কথা! বাধ্য না করা হলেও একটি পরোক্ষ চাপ থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েও মোদী রাজ্যের মন্ত্রী-আমলাদের জন্য নিয়মিত যোগ শিবির চালু করেছিলেন। নিজে আরএসএস-এর প্রচারক হিসেবে কাজ করার সময় থেকেই নিয়মিত যোগাসন করেন। প্রথমে শোনা যাচ্ছিল, ২১ তারিখও তিনি রাজপথে সকলের সঙ্গে যোগাসন করবেন। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, তিনি শুধুই বক্তৃতা দেবেন। কংগ্রেস নেতারা সব দেখেশুনে কটাক্ষ করে বলছেন, মোদীই প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন, যিনি যোগাসন করেন। জওহরলাল নেহরু নিয়মিত যোগাসন করতেন। ইন্দিরা গাঁধী করতেন। তাঁর যোগ-গুরু হিসেবে ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের কথায়, ‘‘নেহরুর সবথেকে পছন্দ ছিল শীর্ষাসন। কিন্তু তিনি কখনও তাঁর বর্তমান উত্তরসূরির মতো এ সব প্রচার করে বেড়াতেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy