২০০১-এ হাওড়ার এই বাড়িতেই থাকতেন সঞ্জীব খন্না ও ইন্দ্রাণী। দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।
ওড়নার আড়ালে চোখের নীচ থেকে চিবুক পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। জেল হেফাজতের নির্দেশ শোনার পরে সামান্য হাসি ফুটে উঠল লিপগ্লস লাগানো ঠোঁটের কোণে।
হাত তুলে বিচারককে নমস্কার করে বেরোনোর আগে নড়ে উঠল ঠোঁট। কিছু বলতে চাইলেন ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়। শনিবার আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে কাগজ-কলম চেয়েছিলেন। দেওয়া হয়নি। এ দিনও তাঁকে চুপ করিয়ে দিলেন পাশে থাকা দুই মহিলা পুলিশকর্মী। ইন্দ্রাণী তখনও জানেন না, পুলিশের জেরা থেকে রেহাই মিললেও তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে অনেক বেশি অস্বস্তিকর একটা খবর।
কী সেটা? রায়গড়ের জঙ্গল খুঁড়ে পাওয়া মানবদেহের হাড় ও দাঁত পাঠানো হয়েছিল ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। মুম্বই পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই ডিএনএ-র সঙ্গে ইন্দ্রাণীর রক্তের নমুনা মিলে গিয়েছে। অতএব পুলিশ এখন নিশ্চিত করে বলতে পারবে যে, রায়গড়ে পাওয়া দেহটি শিনারই। শিনা ইন্দ্রাণীরই মেয়ে এবং তাঁকে খুনই করা হয়েছে। এ বার শিনার সঙ্গে সিদ্ধার্থর ডিএনএ মেলে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা। সিদ্ধার্থকে এই মামলার অন্যতম সাক্ষী করতে চায় পুলিশ। তার জন্য ডিএনএ রিপোর্টটি জরুরি।
২৫ অগস্ট ইন্দ্রাণীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রায় দু’সপ্তাহ পরে এ দিন পুলিশ হেফাজত থেকে জেল হেফাজতে গেলেন তিনি। ধৃত চালক শ্যাম রাইয়েরও জেল হেফাজত হয়েছে। দুপুর ৩টে ৩৫ মিনিটে কক্ষে ঢোকেন ইন্দ্রাণী। গত শনিবার যে পোশাকে আদালতে এসেছিলেন এ দিনও ছিল সেই একই হাল্কা সবুজ রঙের পোশাক। মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় শুনানি।
কিন্তু তৃতীয় জন কোথায়? ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খন্না? বান্দ্রা আদালতে সাংবাদিক-উৎসুকদের চোখ যখন সঞ্জীবকে খুঁজছে, তখন তিনি কার্যত গা ঢাকা দিয়ে আলিপুর আদালত চত্বরে একটি পুলিশের গাড়ির ভিতরে বসে রয়েছেন!
ইন্দ্রাণী ও শ্যামের সঙ্গে সঞ্জীবকেও বান্দ্রা আদালতে আনার কথা ছিল। সঞ্জীবকে না দেখে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা তাঁর খোঁজ নিতে শুরু করেন। তখনই জানা যায়, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কলকাতায়। কী এমন জরুরি দরকার যে আদালতে না হাজির করে অভিযুক্তকে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতায়?
জানা গিয়েছে, রবিবার রাতে ইন্দ্রাণী ও সঞ্জীবকে পুলিশ বান্দ্রা ন্যাশনাল কলেজের পিছনের গলিতে নিয়ে গিয়েছিল। ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল ওই কলেজের সামনে থেকেই শিনাকে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। গলির কোথায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কী ভাবে খুন করা হয়, তদন্তকারীদের তা দেখান সঞ্জীব ও ইন্দ্রাণী। সেই সূত্রেই জানা যায় শিনার পরনে থাকা জুতো-গয়না, সঞ্জীবের আরও একটি ল্যাপটপ ও কিছু নথি রয়ে গিয়েছে কলকাতায়। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তড়িঘড়ি তদন্তকারীরা ভোর ৬টা ১০ মিনিটে জেট এয়ারওয়েজের উড়ানে সঞ্জীবকে নিয়ে রওনা হয়ে যান কলকাতায়। সেই অনুযায়ী সোমবারের বদলে মঙ্গলবার তাঁকে আদালতের সামনে হাজির করানোর অনুমতি চেয়ে নিয়ে বিশেষ আর্জি জানানো হয় বান্দ্রা আদালতের বিচারকের কাছে। আদালত তা মঞ্জুর করে। এ দিন রাত ৯টা ৪০ মিনিটে জেটের বিমানে ফের মুম্বই ফিরিয়ে আনা হয় সঞ্জীবকে।
এ দিন বান্দ্রা আদালতে ইন্দ্রাণীরা ঢোকার প্রায় আধ ঘণ্টা আগেই চলে এসেছিলেন বিচারক জি আর তৌড়। চুপ করে বসেছিলেন ইন্দ্রাণীদের অপেক্ষায়। এজলাস তখন ভিড়ে ভিড়াক্কার। শুনানির সময় ভিড়ের চাপে অসুস্থই হয়ে পড়েন এক আইনজীবী। তার মধ্যেই ইন্দ্রাণীর আইনজীবী গুঞ্জন মঙ্গলা আদালতকে জানান, যা জেরা করার ছিল তা হয়ে গিয়েছে। পুলিশের যা জানার ছিল তা-ও জানা হয়ে গিয়েছে। এ বার ইন্দ্রাণীকে জেল হেফাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। জেলে থাকার সময়ে ইন্দ্রাণী যাতে বাড়ি থেকে আনা খাবার খেতে পারেন এবং নিয়মিত বাড়ি থেকে আনা পোশাক পরতে পারেন তার জন্যও আবেদন জানান গুঞ্জন। বিচারক জানান, ১০ সেপ্টেম্বর সেই আবেদনের শুনানি হবে। ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলে থাকার পরে সে দিন আবার আদালতে পেশ করতে হবে ইন্দ্রাণীকে।
পুলিশি জেরা থেকে ইন্দ্রাণী আপাতত ছুটি পেলেও এ দিন খার থানায় ডেকে ফের লম্বা জেরা করা হয় ইন্দ্রাণীর স্বামী পিটার মুখোপাধ্যায়কে। আদালতে শুনানি চলার সময়েই তাঁকে ডেকে আনা হয় খার থানায়। জেরা চলে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। রাতে কমিশনার রাকেশ মারিয়া নিজেও থানায় যান। তিনিই সাংবাদিকদের জানান, কলকাতা থেকে শিনার জুতো ও গয়না উদ্ধার হয়েছে। ডিএনএ রিপোর্টে শিনা যে ইন্দ্রাণীরই মেয়ে, তা প্রমাণ হয়েছে। মারিয়া জানান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যাট, অডিটরদের একটি দল এবং ইকনমিক অফেন্স উইঙ্গ-এর তদন্তকারীরা এখন মুখোপাধ্যায় পরিবারের সম্পত্তি এবং ভারত-ব্রিটেন-স্পেনে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের ব্যবসায়িক লেনদেনের কাগজপত্র খতিয়ে দেখছেন।
অন্য দিকে সকালে কলকাতায় পৌঁছনোর পর বিধাননগর পুলিশের একটি মেরুন রঙের গাড়িতে চাপিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয় সঞ্জীবকে। হেস্টিংসের চ্যাপেল রোডে সঞ্জীবের বাড়ি ছাড়াও তাঁর এক বন্ধু এবং ইন্দ্রাণী-পিটারের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। মধ্য কলকাতায় সঞ্জীবের একটি অফিসেও নিয়ে যাওয়া হয় বলে পুলিশ সূত্রে দাবি। কলকাতা থেকে এ দিন একটি ল্যাপটপ, একটি মোবাইল এবং কিছু নথি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তার পরে আলিপুর আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় সঞ্জীবকে। তাঁকে গাড়িতে বসিয়েই মুম্বই পুলিশের এক অফিসার আলিপুর আদালতের কোর্ট ইনস্পেক্টর নবকুমার গুপ্তের কাছে যান। সেখানে ট্রানজিট রিমান্ডের আর্জি জমা দেন তাঁরা। বিষয়টি মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চক্রবর্তীর কাছে জানানো হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।
গ্রেফতার হওয়ার পর কলকাতার যে আইনজীবী সঞ্জীবের হয়ে জামিনের সওয়াল করেছিলেন, সেই সেলিম রহমান এ দিন বলেন, ‘‘আইন অনুযায়ী, সঞ্জীবকে এ দিন বান্দ্রা আদালতে তোলার কথা। ফের পুলিশি হেফাজতে নিতে হলে অভিযুক্তকে সশরীরে আদালতে হাজির করাতে হয়। অন্য কোনও আদালতে তাঁকে হাজির করানো হলে তা এ ক্ষেত্রে বৈধ হবে না। ফলে এ দিন সঞ্জীবের পুলিশি হেফাজতে থাকা বেআইনি বলেই ধরতে হবে।’’ তবে পুলিশ ও আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, সঞ্জীবকে ১২ দিন পুলিশ হাজতে পাঠিয়েছিল আদালত। আইনমাফিক তাঁকে আরও দু’দিন নিজেদের হেফাজতে নিতে পারে পুলিশ। অর্থাৎ এ দিনটি বাকি দু’দিনের হিসেব থেকে কাটা যেতে পারে বলে তাঁদের বক্তব্য।
রবিবারই কলকাতায় ফিরেছিলেন শিনার বাবা সিদ্ধার্থ দাস। পুলিশ দাবি করছে, শিনার ভাই মিখাইল বরা-ও আজ মুম্বই থেকে গুয়াহাটি এসে পৌঁছেছে। যদিও দিনভর তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েও মিখাইলের দেখা মেলেনি। মিখাইলের বন্ধুরা দাবি করেছে, মিখাইল মুম্বইতেই আছে। তার মোবাইল বেজে গেলেও কেউ ধরেনি। মরাঠি ভাষায় কম্পিউটারাইজড মহিলাকণ্ঠ জানিয়েছে, গ্রাহক ফোন ধরছেন না। মিখাইল গুয়াহাটিতে থাকলে তার ফোনে মরাঠি গলা কেন? দিসপুর পুলিশের ধারণা, কিছু তথ্য-প্রমাণ মিলতে পারে বলে মুম্বই পুলিশ মিখাইলের ফোনটি রেখে দিয়ে থাকতে পারে। পুলিশের অনুমান, মিখাইল গুয়াহাটি ফিরে অন্য কোথাও আত্মগোপন করেছে।
সহ প্রতিবেদন: রাজীবাক্ষ রক্ষিত, কৌশিক ঘোষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy