—ফাইল চিত্র।
স্বঘোষিত গো-রক্ষকদের তোপ দাগতে গিয়ে পাশে টেনেছেন সঙ্ঘ-প্রধান মোহন ভাগবতকে। কিন্তু তার পরেও সঙ্ঘের অন্দরের প্রবল বিদ্রোহে তুমুল অস্বস্তিতে বিজেপি। জেরবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেও।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গো-রক্ষা সংগঠনের তিরের মুখ এখন ঘুরে গিয়েছে মোদীর দিকে! এই সব সংগঠনের কোনও শাখার তরফে প্রধানমন্ত্রীকে আইনি নোটিস পাঠানোর তোড়জোড় চলছে, কোনওটি প্রধানমন্ত্রীর ‘বেলাগাম’ মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে দেশ জুড়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কোনও শাখা আবার প্রধানমন্ত্রীর ‘সুমতি’ ফেরানোর জন্য যজ্ঞের আয়োজন করছে! সেই সঙ্গে চলছে মোদীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার! গো-রক্ষকদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে যে তাদের সায় রয়েছে, তা বোঝাতে গত কালই সঙ্ঘের তরফে বিবৃতি জারি করা হয়। আজ দলিত নিগ্রহকারীদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলে আরও একটি বিবৃতি জারি করে সঙ্ঘ নেতৃত্ব মোদীর পাশেই দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তাতেও গো-রক্ষকদের হেলদোল নেই।
প্রধানমন্ত্রী ও সঙ্ঘের শীর্ষ নেতৃত্বের বিবৃতির পরেও এই শাখা সংগঠনগুলির ছোবল ভাবাচ্ছে দল ও সঙ্ঘকে। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, এক সময় সংগঠনের প্রসার ঘটানোর জন্য এ ধরনের নানা শাখা সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল। ক্রমশ সেই নাবালক সংগঠনগুলি সাবালক হয়েছে। আর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে নেতৃত্বকেই ছোবল মারতে শুরু করেছে! যেমন এখন, গোরক্ষার প্রশ্নে।
সঙ্ঘের এই নেতাদের কারও কারও বক্তব্য, এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে বহু বার। তারাও বিজেপি-আরএসএসের মতো ক্যাডার-নির্ভর দল। দলের শক্তি বাড়াতে তারাও এক সময় নানা সংগঠনকে এক ছাতার তলায় এনেছে। কিন্তু অনেক সময় এই সব শাখা সংগঠনের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে মূল দলের নেতৃত্বকে। তাদেরও সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। ঠিক যে ভাবে এখন বেলাগাম হয়ে উঠেছে গো-রক্ষক বাহিনী। তবে বিজেপি বা সঙ্ঘ নেতৃত্ব কিন্তু এখনই সুর নরম করার কোনও ইঙ্গিত দেননি।
অনেক দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গো-রক্ষার নামে দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণের খবর আসছে। উত্তরপ্রদেশের ভোটের মুখে এ ধরনের ঘটনায় বিজেপি যে বেজায় বিপাকে, তা বুঝতে পারছেন দল ও সঙ্ঘ নেতৃত্ব। সে কারণে দীর্ঘদিন নীরব থাকার পরে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত ও সঙ্ঘের অন্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রধানমন্ত্রী শনি ও রবি, পরপর দু’দিন স্বঘোষিত গো-রক্ষকদের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। তাঁর মন্তব্য নিয়ে সঙ্ঘের অন্দরে কোনও বিভ্রান্তি যাতে তৈরি না হয়, তার জন্য ‘সাচ্চা’ ও ‘মেকি’ গো-রক্ষকদের মধ্যে ফারাক টেনে মেকিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাওয়াইও দিয়েছেন।
আর এতেই বেজায় চটেছে গো-রক্ষক বাহিনী। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিভিন্ন রাজ্যে গো-রক্ষকদের ধরপাকড়ের প্রস্তুতি শুরু হওয়ার পর। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ দিল্লি পুলিশ গো-রক্ষকদের পাকড়াও করতে দু’টি বিশেষ দল গঠন করেছে। সক্রিয় হয়েছে পঞ্জাব পুলিশও। গত বছর পঞ্জাবের গো-রক্ষা দলের প্রধান সতীশ কুমারকে গরু নিয়ে যাওয়া একটি ট্রাকের ড্রাইভারকে মারতে দেখা গিয়েছিল। পঞ্জাব পুলিশ এখন সতীশ কুমারের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। যা শুনে সতীশ বলেছেন, ‘‘গরুকে রক্ষা করে যদি আমি গুন্ডা হই, তা-ই সই!’’ একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘মোদী ভোট-ব্যাঙ্কের রাজনীতি করে কসাইদের ভোট পেতে চাইছেন!’’ দিল্লিতে ভারতীয় গো-রক্ষক দলের চেয়ারম্যান পবন পণ্ডিত বলেন, ‘‘লোকসভায় আমাদের ভোট দরকার ছিল মোদীর। আর এখন ৮০ শতাংশ গো-রক্ষক ওঁর কাছে গুন্ডা? দেশ জুড়ে আন্দোলনে নামছি আমরা। মোদী জেল খালি রাখুন। হিসেব করে বলুন, কৌন সাচ্চা, কৌন ঝুটা?’’
ভারতীয় গো-রক্ষক দল এমন একটি সংস্থা, গোটা দেশে যাদের স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা প্রায় হাজার ছয়েক। দাদরির ঘটনায় অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগ তারা অস্বীকার করছে না। তবে গুজরাতের উনায় দলিতদের উপরে গো-রক্ষকদের হামলার ঘটনা সাজানো বলে তাদের দাবি। এ দিন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার সভাপতি স্বামী চক্রপাণি বলেন, ‘‘যাঁরা গরু রক্ষার জন্য নিজেদের জীবনপাত করলেন, তাঁদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্য নিন্দনীয়।’’ হিন্দু মহাসভা ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে আইনি নোটিস ধরানোর তোড়জোড় শুরু করেছে। সংস্থার জাতীয় সভাপতি চন্দ্রপ্রকাশ কৌশিক জানান, প্রধানমন্ত্রীর সুমতি ফেরানোর কামনায় যজ্ঞেরও আয়োজন হয়েছে। এমনকী মোদীর রাজ্য গুজরাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছে, পরের লোকসভায় আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন না মোদী!
সঙ্ঘের এক কর্মীর মন্তব্য, ‘‘পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে গিয়ে মোদীর সুর বদলেছে। আর আমেরিকা মোদীকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেখতে চায়, তাই তিনি এখন ধর্মনিরপেক্ষতার ঘাগরা পরেছেন!’’ সঙ্ঘের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া হবে জেনেও মোদী কেন এত বড় ঝুঁকি নিলেন, তা আজ ফুটে উঠেছে উত্তরপ্রদেশের দলিত নেত্রী মায়াবতীর গলায়। তিনি বলেছেন, ‘‘দু’বছর ধরে গো-রক্ষকরা কখনও সংখ্যালঘু, কখনও দলিত নিগ্রহ করেছে। প্রধানমন্ত্রী এখন বুঝছেন, উত্তরপ্রদেশে দলিতদের একটিও ভোট পাবেন না। তাই ঠেলায় পড়ে এত দিন পরে মুখ খুলেছেন।’’ কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন বিরোধী দলও এই প্রশ্নে মোদী এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে।
ঘরে-বাইরে এই প্রবল বিরোধিতা কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, সেটাই এখন বিজেপি ও সঙ্ঘ নেতৃত্বের চিন্তা। বিজেপির এক নেতা বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সব গো-রক্ষকদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেননি। বরং আসল ও নকলের মধ্যে বিভাজন করতে বলেছেন।’’ কিন্তু গো-রক্ষক বাহিনীর বক্তব্য, আশি ভাগই গুন্ডা, এই হিসেব কোথা থেকে পেলেন প্রধানমন্ত্রী? আসল নকল কে বাছবে? গরুকে রক্ষা করতে গিয়ে গো-রক্ষকদের উপরে গুলি চললে, তাঁদের কে বাঁচাবে? আজ পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে গো-হত্যায় নিষেধ নেই। সেখানে গোরুপাচার কে ঠেকাবে? মোদী গো-রক্ষকদের ঠিকুজি বের করতে বলেছেন। একই মঞ্চ থেকে কেন বললেন না, গো-হত্যাকারীদের বিরুদ্ধেও সমান কঠোর ব্যবস্থা নিতে?
গরু নিয়ে গেরুয়া শিবির এখন গরম। কী ভাবে ঠান্ডা হবে, জানে না কেউ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy