আগামী ৩১ মার্চের পরে দশটার বেশি বাতিল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ঘরে রাখলেই কড়া শাস্তি। জরিমানার পরিমাণ ১০ হাজার টাকা বা ধরা পড়া টাকার পাঁচ গুণের মধ্যে যেটা বেশি। কিছু ক্ষেত্রে জরিমানার পাশাপাশি জেলও খাটতে হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের একাংশের দাবি। যার সর্বোচ্চ মেয়াদ ৪ বছর। এর আগে় রিজার্ভ ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে গিয়ে জুতসই ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও জরিমানা হবে।
আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স পাশ হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সই হওয়ার আগে যে হেতু অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে সরকারি ভাবে কিছু জানানো হয় না, তাই কিছু ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। যেমন, এক, শাস্তি কবে থেকে বলবৎ হবে। দুই, জরিমানার সঙ্গে কারাবাসের বন্দোবস্তও থাকবে কি না। অর্ডিন্যান্সের খসড়ায় সেই বিধান ছিল। কিন্তু মন্ত্রিসভা তাতে সিলমোহর বসিয়েছে কি না, স্পষ্ট নয়।
এই ধোঁয়াশা এবং বাতিল নোট সঙ্গে রাখলে শাস্তির বিধান কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিছু অর্থনীতিবিদ বলছেন, কালো টাকার কারবারিরা যে সরকারের চোখ এড়িয়ে কালোকে সাদা করার নানা ফন্দিফিকির বের করে ফেলেছেন, সেটা তো ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। আর তার জেরেই অধিকাংশ পুরনো নোট ফিরে এসেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে। ৮ নভেম্বর বাজারে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ছিল প্রায় ১৫.৪ লক্ষ কোটি। তার মধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ কোটিই জমা পড়ে গিয়েছে। এর পরেও বাকি বাতিল নোট নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নিছক পণ্ডশ্রম বলেই মনে করছেন তাঁরা। ওই অর্থনীতিবিদদের মতে, গোটা নোট-নাকচ পর্বটাই ছেয়ে রইল হাস্যকর সিদ্ধান্ত আর সিদ্ধান্তহীনতায়।
নয়া অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, আমজনতা যাতে অচল নোট জমা করতে পারেন, সে জন্য ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই দিন পর্যন্ত ব্যাঙ্ক বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দু’জায়গাতেই পুরনো নোট জমা করা যাবে। তার পরেও ৩১ মার্চ পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গিয়ে অচল নোট পাল্টে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বিদেশে থাকা নাগরিক বা প্রত্যন্ত এলাকায় মোতায়েন ফৌজিদের কথা ভেবে। অন্য কেউ সেই সুযোগ নিতে গেলে তাঁকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে, কেন তিনি এত দিন টাকা জমা দেননি। জবাব সন্তোষজনক না হলে, বা ভুল প্রমাণিত হলে শাস্তি পেতে হবে তাঁকে। এ ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ ৫ হাজার টাকা বা জমা দিতে আসা টাকার ৫ গুণের মধ্যে যেটা বেশি।
আইনগত প্রয়োজনেই অর্ডিন্যান্স জারি করা হচ্ছে বলে দাবি করে সরকারি সূত্রের বক্তব্য, ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু সরকারি নির্দেশিকা জারি হয়েছিল। কিন্তু আগামী বছরের ৩১ মার্চের পর থেকে পুরনো ৫০০, ১০০০ টাকার নোট কারও কাছে থেকে গেলেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে তা নিয়ে আর দায় থাকবে না, তার আইনি দিকটি নিশ্চিত করতেই এই ‘দ্য স্পেসিফায়েড ব্যাঙ্ক নোটস সেশেশন অব লায়াবিলিটিস অর্ডিন্যান্স’। ১৯৪৬ সালে পরাধীন ভারতে এক বার নোট বাতিল হয়েছিল। এর পর ১৯৭৮-এ মোরারজি দেশাই সরকার ১০০০, ৫০০০ ও ১০,০০০ টাকার নোট বাতিল করে। দু’বারই একই ধরনের অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছিল। যে কোনও নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পরেই এই অর্ডিন্যান্স জরুরি। তবে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির মতে, ‘‘ আইন জরুরি ছিল ঠিকই। কিন্তু অর্ডিন্যান্স না করে উচিত ছিল সংসদেই আইন নিয়ে আসা।’’
তা ছাড়া প্রশ্ন হল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দায়ই যখন থাকছে না, তখন শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে কেন? সরকারি সূত্রবলছে, কেউ টাকার উৎস সম্পর্কে ভুল তথ্য দিতে পারেন। আবার কেউ অন্য পক্ষের, যেমন বিদেশিদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে বাতিল নোট চালানোর চেষ্টা করতে পারেন। তাই শাস্তির ব্যবস্থা। এর আগের দু’বারও শাস্তির বিধান আইনে ছিল।
কিন্তু এ বার অতিরিক্ত হল, ১০টির বেশি বাতিল নোট রাখলেই শাস্তির বন্দোবস্ত। কিন্তু কেউ তো শখ করেও বাতিল নোট জমাতে পারেন। সেটা অপরাধ হবে কেন? সরকারি সূত্রের বক্তব্য, দু’একটা অচল নোট থাকলে তো কিছু বলা হবে না। কিন্তু কালো টাকার কারবারিরা অনেকেই শেষ মুহূর্তে মরিয়া হয়ে পুরনো নোট চালানোর চেষ্টা করছেন। আগামী তিন মাসে কেউ কেউ নিজেদের সংস্থার কর্মীদের অচল নোটে মজুরি দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তাঁদের বলতে পারেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গিয়ে নোট পাল্টে নিতে। কেউ যাতে বাধ্য হয়েও বাতিল নোট না নেন, তা নিশ্চিত করতেই জেল-জরিমানার ব্যবস্থা।
তবে এই যুক্তি মানতে নারাজ অনেকে। প্রবীণ আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেব বলেন, ‘‘কোনও আইন যদি সংবিধানের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তা হলে সেই আইন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হবে এবং তা খারিজও হয়ে যেতে পারে। ১৯৭৮ সালে বাতিল হওয়া ১০০০০ টাকার নোট এখনও কারও কাছে থাকলে তা অপরাধ নয়। কাউকে ঠকিয়ে সেটি চালানোর চেষ্টা করলে তবেই তা অপরাধের পর্যায়ে পড়বে।’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘‘কেন্দ্র ঠিক কী বলেছে আমি দেখিনি। না দেখে কিছু বলা উচিত নয়। তবে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয় এমন কিছু করা উচিত নয়।’’
নোট-বিধি
• ৩১ মার্চের পরে ১০টার বেশি পুরনো নোট রাখলেই শাস্তি
• ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা, সর্বোচ্চ জমা টাকার ৫ গুণ
• ক্ষেত্রবিশেষে সঙ্গে ৪ বছর পর্যন্ত কারাবাস
• রিজার্ভ ব্যাঙ্কে এখন নোট জমা দিলে ব্যাখ্যা দিতে হবে
• ভুল তথ্য দিলে ন্যূনতম জরিমানা ৫ হাজার টাকা
• সর্বোচ্চ জরিমানা জমা দিতে আসা টাকার ৫ গুণ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy